মুল গ্রন্থ:- আত্মশক্তি
লেখক:- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরব
প্রবন্ধ:- স্বদেশী সমাজ
বন্ধ
অনুচ্ছেদ :- প্রথম
বাংলাদেশের জলকষ্ট নিবারণ সম্বন্ধে গবমেন্টের মন্তব্য
প্রকাশিত হইলে পর এই প্রবন্ধ লিখিত হয় । “হজলা স্বফলা” বঙ্গভূমি তৃষিত হইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু সে চাতক পক্ষীর মতো উধের
দিকে তাকাইয়া আছে– কতৃপক্ষীয়ের
জলবর্ষণের ব্যবস্থা না করিলে তাহার আর গতি নাই । গুরুগুরু মেঘগর্জন শুরু হইয়াছে— গবর্মেন্ট সাড়া দিয়াছেন– তৃষ্ণানিবারণের যাহয়-একটা উপায়
হয়তে হুইবে—
অতএব আপাতত আমরা সেজন্য
উদবেগ প্রকাশ করিতে বসি নাই । আমাদের চিন্তার বিষয় এই যে, পূর্বে আমাদের যে একটি ব্যবস্থা ছিল, ষাহাতে সমাজ অত্যন্ত সহজ নিয়মে
আপনার সমস্ত অভাব আপনিই মিটাইয়া লইত— দেশে তাহার কি লেশমাত্র অবশিষ্ট থাকিবে না । আমাদের যে-সকল অভাব বিদেশীরা
গড়িয়া তুলিয়াছে ও তুলিতেছে, সেইগুলাই না হয় বিদেশী পূরণ করুক । অল্পক্লিষ্ট ভারতবর্ষের চায়ের
তৃষ্ণা জন্মাইয়া দিবার জন্য কৰ্জনসাহেব উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছেন, আচ্ছা, না হয় অ্যাও যুল-সম্প্রদায় আমাদের
চায়ের বাটি ভর্তি করিতে থাকুন ; এবং এই চায়ের চেয়েও যে জালাময় তরলরসের তৃষ্ণ — যাহা প্রলয়কালের সুর্যাস্তচ্ছটার
দ্যায় বিচিত্র উজ্জল দীপ্তিতে উত্তরোত্তর আমাদিগকে প্রলুব্ধ করিয়া তুলিতেছে— তাহা পশ্চিমের সামগ্রী এবং
পশ্চিমদিগদেবী তাহার পরিবেষণের ভার লইলে অসংগত হয় না— কিন্তু জলের তৃষ্ণা তো স্বদেশের
খাটি সনাতন জিনিস ! ব্রিটিশ
গবর্মেন্ট আসিবার পূর্বে আমাদের জলপিপাসা ছিল এবং এতকাল তাহার নিবৃত্তির উপায় বেশ
ভালোরূপেই হইয়া আসিয়াছে— এজন্য
শাসনকর্তাদের রাজদগুকে কোনোদিন তো চঞ্চল হইয়া উঠিতে হয় নাই । আমাদের দেশে যুদ্ধবিগ্রহ, রাজ্যরক্ষা এবং বিচারকার্ধ রাজা
করিয়াছেন,
কিন্তু বিদ্যাদান হইতে
জলদান পর্যন্ত সমস্তই সমাজ এমন সহজভাবে সম্পন্ন করিয়াছে যে, এত নব নব শতাব্দীতে এত নব নব রাজার
রাজত্ব আমাদের দেশের উপর দিয়া বস্তার মতে বহিয়া গেল, তবু আমাদের ধম নষ্ট করিয়া আমাদিগকে
পশুর মতো করিতে পারে নাই, সমাজ
নষ্ট করিয়া আমাদিগকে একেবারে লক্ষ্মীছাড়া করিয়া দেয় নাই । রাজায় রাজায় লড়াইয়ের অস্ত নাই— কিন্তু আমাদের মর্মরায়মাণ
বেণুকুঞ্জে,
আমাদের আত্মশক্তি ¢२१ আমর্কাঠালের বনচ্ছায়ায় দেবায়তন
উঠিতেছে,
অতিথিশাল স্থাপিত হইতেছে, পুষ্করিণী-খনন চলিতেছে, গুরুমহাশয় শুভংকরী কৰাইতেছেন, টোলে শাস্ত্র-অধ্যাপনা বদ্ধ নাই, চণ্ডীমণ্ডপে রামায়ণপাঠ হইতেছে এবং
কীর্তনের আরাবে পল্লীর প্রাঙ্গণ মুখরিত। সমাজ বাহিরের সাহায্যের অপেক্ষা
রাখে নাই এবং বাহিরের উপদ্রবে थैबडे झग्न नाहे । দেশে এই যে সমস্ত লোকহিতকর
মঙ্গলকর্ম ও আনন্দ-উৎসব এতকাল অব্যাহত ভাবে সমস্ত ধনিদরিদ্রকে ধন্য করিয়া
আসিয়াছে,
এজন্য কি চাদার খাতা কুক্ষিগত
করিয়া উৎসাহী লোকদিগকে দ্বারে দ্বারে মাখা খুড়িয়া মরিতে হইয়াছে, না, রাজপুরুষদিগকে মুদীর্ঘ মন্তব্যসহ
পরোয়ানা বাহির করিতে হইয়াছে ! নিশ্বাস লইতে যেমন আমাদের কাহাকেও হাতে-পায়ে ধরিতে হয় না, রক্তচলাচলের জন্য যেমন টেীনহল-মৗটিং
অনাবশ্বক—
সমাজের সমস্ত অত্যাবহ্যক
হিতকর ব্যাপার সমাজে তেমনি অত্যস্ত স্বাভাবিক নিয়মে ঘটিয়| আসিয়াছে ।
অনুচ্ছেদ :- দ্বিতীয়
আজ আমাদের দেশে জল নাই বলিয়া যে
আমরা আক্ষেপ করিতেছি, সেটা
সামান্ত কথা। সকলের চেয়ে গুরুতর শোকের বিষয় হইয়াছে, তাহার মূল কারণট। আজ সমাজের মনটা সমাজের মধ্যে নাই । আমাদের সমস্ত মনোযোগ বাহিরের দিকে
গিয়াছে । কোনো নদী ষে-গ্রামের পাশ্ব দিয়া বরাবর বহিয়া আসিয়াছে, সে যদি একদিন সে-গ্রামকে ছাড়িয়া
অন্যত্র তাহার স্রোতের পথ লইয়া যায়, তবে সে-গ্রামের জল নষ্ট হয়, ফল নষ্ট হয়, স্বাস্থ্য নষ্ট হয়, বাণিজ্য নষ্ট হয়, তাহার বাগান জঙ্গল হইয়া পড়ে, তাহার পূর্বসমৃদ্ধির ভগ্নাবশেষ আপন
দীর্ণ ভিত্তির ফাটলে ফাটলে বট-অশ্বখকে প্রশ্রয় দিয়া পেচক-বাছুড়ের বিহারস্থল
হইয়া উঠে । মামুষের চিত্তস্রোত নদীর চেয়ে সামান্য জিনিস নহে। সেই চিত্তপ্রবাহ চিরকাল বাংলার
ছায়াশীতল গ্রামগুলিকে অনাময় ও আনন্দিত করিয়া রাখিয়াছিল— এখন বাংলার সেই পল্লীক্রোড় হইতে
বাঙালির চিত্তধারা বিক্ষিপ্ত হইয়া গেছে। তাই তাহার দেবালয় জীর্ণপ্রায়— সংস্কার করিয়া দিবার কেহ নাই, তাহার জলাশয়গুলি দুষিত— পঙ্কোদ্ধার করিবার কেহ নাই, সমৃদ্ধ ঘরের অট্টালিকাগুলি
পরিত্যক্ত—
সেখানে উৎসবের আনন্দধ্বনি
উঠে না। কাজেই এখন জলদানের কর্তা সরকার বাহাদুর, স্বাস্থ্যদানের কর্তা সরকার বাহাদুর, বিস্তাদানের ব্যবস্থার জন্যও সরকার
বাহাদুরের দ্বারে গলবস্ত্র হইয়া ফিরিতে হয়। যে-গাছ আপনার ফুল আপনি ফুটাইত, সে আকাশ হইতে পুষ্পবৃষ্টির জন্য
তাহার সমস্ত শীর্ণ শাখাপ্রশাখা উপরে তুলিয়া তাহার সার্থকতা কী ? ইংরেজিতে যাহাকে স্টেট বলে, আমাদের দেশে আধুনিক ভাষায় তাহাকে
বলে সরকার। এই সরকার প্রাচীন ভারতবর্ষে রাজশক্তি আকারে ছিল । কিন্তু বিলাতের স্টেটের সঙ্গে
আমাদের রাজশক্তির প্রভেদ আছে। বিলাত, দেশের সমস্ত কল্যাণকর্মের ভার স্টেটের হাতে সমর্পণ করিয়াছে— ভারতবর্ষ তাহা আংশিকভাবে মাত্র
করিয়াছিল । দেশের র্যাহারা গুরুস্থানীয় ছিলেন, যাহারা সমস্ত দেশকে বিনা বেতনে
বিদ্যাশিক্ষা ধর্মশিক্ষা দিয়া আসিয়াছেন, তাহাদিগকে পালন করা পুরস্কৃত করা যে রাজার কর্তব্য ছিল না
তাহা নহে—
কিন্তু কেবল আংশিক ভাবে ; বস্তুত সাধারণত সে কতব্য প্রত্যেক
গৃহীর। রাজা যদি সাহায্য বন্ধ করেন, হঠাৎ যদি দেশ অরাজক হইয়া আসে, তথাপি সমাজের বিদ্যাশিক্ষা
ধর্মশিক্ষা একান্ত ব্যাঘাতপ্রাপ্ত হয় না । রাজা ষে প্রজাদের জন্য দীঘিকা খনন
করিয়া দিতেন না, তাহা
নহে— কিন্তু সমাজের সম্পন্ন
ব্যক্তিমাত্রই যেমন দিত, তিনিও
তেমনি দিতেন । রাজা অমনোযোগী হইলেই দেশের জলপাত্র রিক্ত হইয়া যাইত না । বিলাতে প্রত্যেকে আপন আরাম-আমোদ ও
স্বার্থসাধনে স্বাধীন— তাহারা
কর্তব্যভারে আক্রাস্ত নহে— তাহাদের
সমস্ত বড়ো বড়ো কর্তব্যভার রাজশক্তির উপর স্থাপিত ।
অনুচ্ছেদ :- তৃতীয়
আমাদের দেশে রাজশক্তি অপেক্ষাকৃত
স্বাধীন—
প্রজাসাধারণ সামাজিক
কর্তব্যদ্বারা আবদ্ধ । রাজা যুদ্ধ করিতে যান, শিকার করিতে যান, রাজকাৰ্য করুন বা আমোদ করিয়া দিন কাটান, সেজন্য ধর্মের বিচারে তিনি দায়ী
হইবেন— কিন্তু জনসাধারণ নিজের মঙ্গলের জন্য
র্তাহার উপরে নিতান্ত নির্ভর করিয়া বসিয়া থাকে না— সমাজের কাজ সমাজের প্রত্যেকের উপরেই
আশ্চর্যরূপে বিচিত্ররূপে ভাগ করা রহিয়াছে । এইরূপ থাকাতে আমরা ধর্ম বলিতে যাহা
বুঝি, তাহা সমাজের সর্বত্র সঞ্চারিত হইয়া
আছে । আমাদের প্রত্যেককেই স্বার্থসংযম ও
আত্মত্যাগচৰ্চা করিতে হইয়াছে । আমরা প্রত্যেকেই ধর্মপালন করিতে বাধ্য। ইহা হইতে স্পষ্ট বুঝা যাইবে, ভিন্ন ভিন্ন সভ্যতার প্রাণশক্তি
ভিন্ন ভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত। সাধারণের কল্যাণভার ঘেখানেই পুঞ্জিত হয়, সেইখানেই দেশের মৰ্মস্থান। সেইখানে আঘাত করিলেই সমস্ত দেশ সাংঘাতিকরূপে
আহত হয়। বিলাতে রাজশক্তি যদি বিপর্যন্ত হয়, তবে সমস্ত দেশের বিনাশ উপস্থিত হয় । আত্মশক্তি এইজন্যই যুরোপে পলিটিক্স
এত অধিক গুরুতর ব্যাপার । আমাদের দেশে সমাজ যদি পঙ্গু হয়, তবেই যথার্থভাবে দেশের সংকটাবস্থা
উপস্থিত হয় । এইজন্ত আমরা এতকাল রাষ্ট্ৰীয় স্বাধীনতার জন্য প্রাণপণ করি নাই
কিন্তু সামাজিক স্বাধীনতা সর্বতোভাবে বাচাইয়া আসিয়াছি । নিঃস্বকে ভিক্ষাদান হইতে সাধারণকে
ধর্মশিক্ষাদান এ সমস্ত বিষয়েই ৰিলাতে স্টেটের উপর নির্ভর— আমাদের দেশে ইহা জনসাধারণের
ধর্মব্যবস্থার উপরে প্রতিষ্ঠিত– এইজন্য ইংরেজ স্টেটকে বাচাইলেই বাচে, আমরা ধর্মব্যবস্থাকে বাচাইলেই
বাচিয়া যাই। ইংলণ্ডে স্বভাবতই স্টেটকে জাগ্রত রাথিতে সচেষ্ট রাখিতে জনসাধারণ
সর্বদাই নিযুক্ত। সম্প্রতি আমরা ইংরেজের পাঠশালায় পড়িয়া স্থির করিয়াছি, অবস্থানিবিচারে গভর্মেন্টকে খোচা
মারিয়া মনোযোগী করাই জনসাধারণের সর্বপ্রধান কর্তব্য। ইহা বুঝিলাম না যে, পরের শরীরে নিয়তই বেলেস্ত্রা
লাগাইতে থাকিলে নিজের ব্যাধির চিকিৎসা করা হয় না । - আমরা তর্ক করিতে ভালোবালি, অতএব এ তর্ক এখানে ওঠা অসম্ভব নহে
যে, সাধারণের কর্মভার সাধারণের
সর্বাঙ্গেই সঞ্চারিত হইয়া থাকা ভালো, না, তাহ
বিশেষ ভাবে সরকারনামক একটা জায়গায় নির্দিষ্ট হওয়া ভালো । আমার বক্তব্য এই যে, এ তর্ক বিদ্যালয়ের ডিবেটিং ক্লাবে
করা যাইতে পারে, কিন্তু
আপাতত এ তর্ক আমাদের কোনো কাজে লাগিবে না । কারণ, এ-কথা আমাদিগকে বুঝিতেই হইবে, বিলাতরাজ্যের স্টেট সমস্ত সমাজের
সম্মতির উপরে অবিচ্ছিন্নরূপে প্রতিষ্ঠিত— তাহা সেখানকার স্বাভাবিক নিয়মেই অভিব্যক্ত হইয়া উঠিয়াছে। শুদ্ধমাত্র তর্কের দ্বারা আমরা তাহা
লাভ করিতে পারিব না— অত্যন্ত
ভালো হইলেও তাহা আমাদের অনধিগম্য । আমাদের দেশে সরকারবাহাদুর সমাজের কেহই নন, সরকার সমাজের বাহিরে। অতএব যে-কোনো বিষয় তাহার কাছ হইতে
প্রত্যাশা করিব, তাহা
স্বাধীনতার মূল্য দিয়া লাভ করিতে হইবে । যে-কৰ্ম সমাজ সরকারের দ্বারা
করাইয়া লইবে, সেই
কর্মসম্বন্ধে সমাজ নিজেকে অকৰ্মণ্য করিয়া তুলিবে । অথচ এই অকমণ্যতা আমাদের দেশের
স্বভাবসিদ্ধ ছিল না । আমরা নানা জাতির, নানা রাজার অধীনতাপাশ গ্রহণ করিয়া আসিয়াছি, কিন্তু সমাজ চিরদিন আপনার সমস্ত কাজ
আপনি নির্বাহ করিয়া আসিয়াছে, ক্ষুদ্রবৃহৎ কোনো বিষয়েই বাহিরের অন্ত কাহাকেও হস্তক্ষেপ করিতে
দেয় নাই । সেইজন্য রাজশ্ৰী যখন দেশ হইতে নির্বাসিত, সমাজলক্ষ্মী তখনো বিদায় আজ আমরা সমাজের সমস্ত কর্তব্য নিজের
চেষ্টায় একে একে সমাজবহির্ভূক্ত স্টেটের হাতে তুলিয়া দিবার জন্য উদ্যত হইয়াছি। এমন কি, আমাদের সামাজিক প্রথাকেও ইংরেজের
আইনের দ্বারাই আমরা অপরিবর্তনীয়রূপে আষ্টেপৃষ্ঠে বাধিতে দিয়াছি— কোনো আপত্তি করি নাই। এ-পর্যন্ত হিন্দুসমাজের ভিতরে
থাকিয়া নব নব সম্প্রদায় আপনাদের মধ্যে বিশেষ বিশেষ আচারবিচারের প্রবর্তন
করিয়াছে,
হিন্দুসমাজ তাহাদিগকে
তিরস্কৃত করে নাই । আজ হইতে সমস্তই ইংরেজের আইনে বাধিয়া গেছে— পরিবর্তনমাত্রেই আজ নিজেকে অহিন্দু
বলিয়া ঘোষণা করিতে বাধ্য হইয়াছে। ইহাতে বুঝা যাইতেছে, যেখানে আমাদের মর্মস্থান— যে মর্মস্থানকে আমরা নিজের অন্তরের
মধ্যে সযত্নে রক্ষা করিয়া এতদিন বাচিয়া আসিয়াছি, সেই আমাদের অন্তরতম মর্মস্থান— আজ অনাবৃত অবারিত হইয়া পড়িয়াছে, সেখানে আজ বিকলতা আক্রমণ করিয়াছে। ইহাই বিপদ, জলকষ্ট বিপদ নহে । পূর্বে র্যাহারা বাদশাহের দরবারে
রায়রায় হইয়াছেন, নবাবরা
যাহাদের মন্ত্রণা ও সহায়তার জন্য অপেক্ষা করিতেন, তাহারা এই রাজপ্রসাদকে যথেষ্ট জ্ঞান
করিতেন না—
সমাজের প্রসাদ রাজপ্ৰসাদের
চেয়ে তাহাদের কাছে উচ্চে ছিল । তাহারা প্রতিপত্তিলাভের জন্য নিজের সমাজের দিকে তাকাইতেন । রাজরাজেশ্বরের রাজধানী দিল্লি
তাহাদিগকে যে-সম্মান দিতে পারে নাই, সেই চরম সম্মানের জন্য র্তাহাদিগকে অখ্যাত জন্মপল্লীর
কুটিরদ্ধারে আসিয়া দাড়াইতে হইত। দেশের সামান্ত লোকেও বলিবে মহদাশয় ব্যক্তি, ইহা সরকারদত্ত রাজা-মহারাজা উপাধির
চেয়ে তাহাদের কাছে বড়ো ছিল । জন্মভূমির সম্মান ইহারা অস্তরের সহিত বুঝিয়াছিলেন— রাজধানীর মাহাত্ম্য, রাজসভার গৌরব ইহাদের চিত্তকে নিজের
পল্পী হইতে বিক্ষিপ্ত করিতে পারে নাই । এইজন্য দেশের অখ্যাত গ্রামেও কোনোদিন জলের কষ্ট হয় নাই, এবং মচুন্যত্বচর্চার সমস্ত ব্যবস্থা
পল্লীতে পল্লীতে সর্বত্রই রক্ষিত হইত। দেশের লোক ধন্য বলিবে, ইহাতে আজ আমাদের স্বখ নাই ; কাজেই দেশের দিকে আমাদের চেষ্টার
স্বাভাবিক গতি নহে । ” এখন
সরকারের নিকট হইতে হয় ভিক্ষা, নয় তাগিদ দরকার হইয়া পড়িয়াছে । এখন দেশের জলকষ্ট-নিবারণের জন্য
গবমেন্ট দেশের লোককে তাগিদ দিতেছেন— স্বাভাবিক তাগিদগুলা সব বন্ধ হইয়া গেছে । দেশের লোকের নিকটে খ্যাতি, তাহাও রোচে না । আমাদের হৃদয় যে গোরার কাছে দাসখত
লিখিয়া দিয়াছে, আমাদের
রুচি যে সাহেবের দোকানে বিকাইয়া গেল ! আমাকে ভুল বুঝিবার সম্ভাবনা আছে। আমি এ-কথা বলিতেছি না যে, আত্মশক্তি |
অনুচ্ছেদ :- চতুর্থ
সকলেইই আপন আপন পল্লীর মাটি আঁকড়াইয়া
পড়িয়া থাক,
বিদ্যা ও ধনমান অর্জনের
জন্য বাহিরে যাইবার জন্য কোনো প্রয়োজন নাই। যে আকর্ষণে বাঙালিজাতটাকে বাহিরে
টানিতেছে,
তাহার কাছে কৃতজ্ঞতা
স্বীকার করিতেই হইবে— তাহাতে
. বাঙালির সমস্ত শক্তিকে উদবোধিত করিয়া তুলিতেছে এবং বাঙালির কর্মক্ষেত্রকে
ব্যাপক করিয়া তাহার চিত্তকে বিস্তীর্ণ করিতেছে । কিন্তু এই সময়েই বাঙালিকে নিয়ত
স্মরণ করাইয়া দেওয়া দরকার যে, ঘর ও বাহিরের ষে স্বাভাবিক সম্বন্ধ, তাহ যেন একেবারে উলটাপালটা হইয়া না
যায়। বাহিরে অর্জন করিতে হইবে, ঘরে সঞ্চয় করিবার জন্যই । বাহিরে শক্তি খাটাইতে হইলেও হৃদয়কে
আপনার ঘরে রাখিতে হইবে । শিক্ষা করিব বাহিরে, প্রয়োগ করিব ঘরে। কিন্তু আমরা আজকাল— ঘর কৈম্বু বাহির, বাছির কৈমু ঘর, পর কৈলু আপন, আপন কৈমু পর। এইজন্ত কবিকথিত “স্রোতের সেওলি”র মতো ভাসিয়াই চলিয়াছি । কিন্তু বাঙালির চিত্ত ঘরের মুখ
লইয়াছে,–
নানা দিক হইতে তাহার প্রমাণ
পাওয়া যাইতেছে । কেবল যে স্বদেশের শাস্ত্র আমাদের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করিতেছে এবং
স্বদেশী ভাষা স্বদেশী সাহিত্যের দ্বারা অলংকৃত হইয়া উঠিতেছে, তাহা নহে,— স্বদেশের শিল্পদ্রব্য আমাদের কাছে
আদর পাইতেছে,
স্বদেশের ইতিহাস আমাদের গবেষণাবৃত্তিকে
জাগ্রত করিতেছে, রাজদ্বারে
ভিক্ষাযাত্রার জন্য যে পাথেয় সংগ্ৰহ করিয়াছিলাম, তাহা প্রত্যহুই একটু একটু করিয়া
আমাদিগকে গৃহদ্বারে পৌছাইয়া দিবারই সহায়তা করিতেছে । এমন অবস্থায় দেশের কাজ প্রকৃতভাবে
আরম্ভ হইয়াছে, বলিতে
হইবে । এখন কতকগুলি অদ্ভূত অসংগতি আমাদের চোখে ঠেকিবে এবং তাহা সংশোধন
করিয়া লইতে হইবে । প্রোভিনশাল কনফারেন্সই তাহার একটি উৎকট দৃষ্টান্ত । এ কনফারেন্স দেশকে মন্ত্রণা দিবার
জন্য সমবেত,
অথচ ইহার ভাষা বিদেশী । আমরা ইংরেজি-শিক্ষিতকেই আমাদের
নিকটের লোক বলিয়া জানি— আপামর
সাধারণকে আমাদের সঙ্গে অস্তরে অস্তরে এক করিতে না পারিলে যে আমরা কেহই নহি, এ-কথা কিছুতেই আমাদের মনে হয় না । সাধারণের সঙ্গে আমরা একটা দুর্তেম্ভ
পার্থক্য তৈরি করিয়া তুলিতেছি। বরাবর তাহাদিগকে আমাদের সমস্ত আলাপআলোচনার বাহিরে খাড়া
করিয়া রাখিয়াছি । আমরা গোড়াগুড়ি বিলাভের | হৃদয়হরণের
জন্ত ছলবলকৌশল সাজসরঞ্জামের বাকি কিছুই রাখি নাই— কিন্তু দেশের হৃদয় যে তদপেক্ষ
মহামূল্য এবং তাহার জন্তও যে বহুতর সাধনার আবগুক, এ-কথা আমরা মনেও করি নাই । পোলিটিক্যাল সাধনার চরম উদ্দেশ্য
একমাত্র দেশের হৃদয়কে এক করা । কিন্তু দেশের ভাষা ছাড়িয়া, দেশের প্রথা ছাড়িয়া, কেবলমাত্র বিদেশীয় হৃদয় আকর্ষণের
জন্য বহুবিধ আয়োজনকেই মহোপকারী পোলিটিক্যাল শিক্ষা বলিয়া গণ্য করা আমাদেরই
হতভাগ্য দেশে প্রচলিত হইয়াছে । দেশের হৃদয়লাভকেই যদি চরম লাভ বলিয়া স্বীকার করি, তৰে সাধারণ কার্ধকলাপে যে-সমস্ত
চালচলনকে আমরা অত্যাবগুক বলিয়া অভ্যাস করিয়া ফেলিয়াছি, সে-সমস্তকে দূরে রাখিয়া দেশের
যথার্থ কাছে যাইবার কোন কোন পথ চিরদিন খোলা আছে, সেইগুলিকে দৃষ্টির সম্মুখে আনিতে
হইবে । মনে করে, প্রোভিনখাল
কনফারেন্সকে যদি আমরা যথার্থই দেশের মন্ত্রণার কার্ষে নিযুক্ত করিতাম, তবে আমরা কী করিতাম ? তাহা হইলে আমরা বিলাতি ধাচের একটা
সভা না বানাইয়া দেশী ধরনের একটা বৃহৎ মেলা করিতাম । সেখানে যাত্রা-গান-আমোদ-আহ্লাদে
দেশের লোক দূরদূরান্তর হইতে একত্র হইত। সেখানে দেশী পণ্য ও কৃষিদ্রব্যের প্রদর্শনী হইত। সেখানে ভালো কথক, কীর্তন-গায়ক ও যাত্রার দলকে পুরস্কার
দেওয়া হইত। সেখানে ম্যাজিক লণ্ঠন প্রভৃতির সাহায্যে সাধারণ লোকদিগকে
স্বাস্থ্যতত্ত্বের উপদেশ স্বম্পষ্ট করিয়া বুঝাইয়া দেওয়া হইত এবং আমাদের
যাহা-কিছু বলিবার কথা আছে, যাহা-কিছু
স্থখছুঃখের পরামর্শ আছে, তাহা
ভদ্রাভদ্রে একত্রে মিলিয়া সহজ বাংলা ভাষায় আলোচনা করা যাইত। আমাদের দেশ প্রধানত পল্লীবাসী। এই পল্লী মাঝে মাঝে যখন আপনার
নাড়ীর মধ্যে বাহিরের বৃহৎ জগতের রক্তচলাচল অনুভব করিবার জন্ত উংস্থক হইয়৷ উঠে, তখন মেলাই তাহার প্রধান উপায় । এই মেলাই আমাদের দেশে বাহিরকে ঘরের
মধ্যে আহবান । এই উৎসবে পল্লী আপনার সমস্ত সংকীর্ণতা বিস্তৃত হয়— তাহার হৃদয় খুলিয়া দান করিবার ও
গ্রহণ করিবার এই প্রধান উপলক্ষ্য । যেমন আকাশের জলে জলাশয় পূর্ণ করিবার সময় বর্ষাগম, তেমনি বিশ্বের ভাবে পল্লীর হৃদয়কে
ভরিয়া দিবার উপযুক্ত অবসর মেলা । এই মেলা আমাদের দেশে অত্যন্ত স্বাভাবিক একটা সভা উপলক্ষ্যে
যদি দেশের লোককে ভাক দাও, তৰে
তাহারা সংশয় লইয়া আসিবে, তাহাদের
মন খুলিতে অনেক দেরি হইবে—কিন্তু
মেলা উপলক্ষ্যে যাহারা একত্র হয় তাহারা সহজেই আtঞ্চাশক্তি
হৃদয় খুলিয়াই আলে— স্বতরাং
এইখানেই দেশের মন পাইবার প্রকৃত অবকাশ ঘটে । পল্পীগুলি যেদিন হাল-লাঙল বন্ধ
করিয়া ছুটি লইয়াছে, সেইদিনই
তাহাদের কাছে আসিয়া বসিবার দিন । বাংলাদেশে এমন জেলা নাই যেখানে নানা স্থানে বৎসরের নানা
সময়ে মেলা না হইয়া থাকে— প্রথমত
এই মেলাগুলির তালিকা ও বিবরণ সংগ্রহ করা আমাদের কর্তব্য । তাহার পরে এই মেলাগুলির স্থত্রে
দেশের লোকের সঙ্গে যথার্থভাবে পরিচিত হইবার উপলক্ষ্য আমরা যেন অবলম্বন করি । প্রত্যেক জেলার ভদ্র শিক্ষিত
সম্প্রদায় তাহাদের জেলার মেলাগুলিকে যদি নবভাবে জাগ্রত, নবপ্রাণে সজীব করিয়া তুলিতে পারেন, ইহার মধ্যে দেশের শিক্ষিতগণ যদি
তাহাদের হৃদয় সঞ্চার করিয়া দেন, এই-সকল মেলায় যদি তাহার। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সম্ভাব
স্থাপন করেন—
কোনোপ্রকার নিষ্ফল
পলিটিক্সের সংস্রব না রাখিয়া বিদ্যালয়, পথঘাট, জলাশয়, গোচর-জমি
প্রভৃতি সম্বন্ধে জেলার যে-সমস্ত অভাব আছে, তাহার প্রতিকারের পরামর্শ করেন, তবে অতি অল্পকালের মধ্যে স্বদেশকে
যথার্থ ই সচেষ্ট করিয়া তুলিতে পারেন। আমার বিশ্বাস, যদি ঘুরিয়া ঘুরিয়া বাংলাদেশে নানা স্থানে মেলা করিবার
জন্ত এক দল লোক প্রস্তুত হন,— তাহারা নূতন নূতন যাত্রা, কীর্তন, কথকতা রচনা করিয়া সঙ্গে বায়োস্কোপ, ম্যাজিকলন্ঠন, ব্যায়াম ও ভোজবাজির আয়োজন লইয়া
ফিরিতে থাকেন, তবে
ব্যয়নির্বাহের জন্য র্তাহাদিগকে কিছুমাত্র ভাবিতে হয় না। র্তাহার যদি মোটের উপরে প্রত্যেক
মেলার জন্য জমিদারকে একটা বিশেষ খাজনা ধরিয়া দেন এবং দোকানদারের নিকট হইতে
যথানিয়মে বিক্রয়ের লভ্যাংশ আদায় করিবার অধিকার প্রাপ্ত ছন— তবে উপযুক্ত স্থব্যবস্থা দ্বারা
সমস্ত ব্যাপারটাকে বিশেষ লাভকর করিয়া তুলিতে পারেন । এই লাভের টাকা হইতে পারিশ্রমিক ও
অন্যান্ত খরচ বাদে যাহা উদবুত্ত হইবে, তাহা যদি দেশের কার্বেই লাগাইতে পারেন, তবে সেই মেলার দলের সহিত সমস্ত
দেশের হৃদয়ের সম্বন্ধ অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হইয়া উঠিবে— ইহারা সমস্ত দেশকে তন্ন ভন্ন করিয়া
জানিবেন এবং ইহাদের দ্বারা ষে কত কাজ হইতে পারিবে, তাহা বলিয়া শেষ করা যায় না ।
অনুচ্ছেদ :-- ষষ্ঠ
আমাদের দেশে চিরকাল আনন্দ-উৎসবের
স্থত্রে লোককে সাহিত্যরস ও ধর্মশিক্ষা দান করা হইয়াছে । সম্প্রতি নানা কারণবশতই অধিকাংশ
জমিদার শহরে আকৃষ্ট হইয়াছেন। তাহাদের পুত্রকষ্ঠার বিবাহাদি ব্যাপারে যাহা-কিছু
আমোদ-আহলাদ,
সমস্তই কেবল শহরের ধনী
বন্ধুদিগকে থিয়েটার ও নাচগান দেখাইয়াই সম্পন্ন হয়। অনেক জমিদার ক্রিয়াকর্মে প্রজাদের
নিকট হইতে চাদ আদায় করিতে কুষ্ঠিত হন না— সে-স্থলে “ইতরে জনা: মিষ্টারের উপায় জোগাইতে থাকে, কিন্তু "মিষ্টায়ম” *ইতরে জনাঃ” কণামাত্র ভোগ করিতে পায় না— ভোগ করেন “বান্ধবাঃ” এবং "সাহেবাঃ" । ইহাতে বাংলার গ্রামসকল দিনে দিনে
নিরানন্দ হইয়া পড়িতেছে এবং যে-সাহিত্যে দেশের আবালবৃদ্ধবনিতার মনকে সরস ও শোভন
করিয়া রাখিয়াছিল, তাহা
প্রত্যহই সাধারণ লোকের আয়ত্তাতীত হইয়া উঠিতেছে । আমাদের এই কল্পিত মেলা-সম্প্রদায়
যদি সাহিত্যের ধারা, আনন্দের
স্রোত বাংলার পল্লীদ্বারে আর-একবার প্রবাহিত করিতে পারেন, তবে এই শস্যশ্রামলা বাংলার অন্তঃকরণ
দিনে দিনে শুষ্ক মরুভূমি হইয়া যাইবে না । আমাদিগকে এ-কথা মনে রাখিতে হইবে যে, যে-সকল বড়ো বড়ো জলাশয় আমাদিগকে
জলদান স্বাস্থ্যদান করিত, তাহারা
দূষিত হইয়া কেবল যে আমাদের জলকষ্ট ঘটাইয়াছে তাহা নহে, তাহারা আমাদিগকে রোগ ও মৃত্যু বিতরণ
করিতেছে—
তেমনি আমাদের দেশে যে-সকল
মেলা ধর্মের নামে প্রচলিত আছে, তাহাদেরও অধিকাংশ আজকাল ক্রমশ দূষিত হইয়। কেবল যে লোকশিক্ষার অযোগ্য হইয়াছে
তাহা নহে,
কুশিক্ষারও আকর হইয়া
উঠিয়াছে। উপেক্ষিত শস্তক্ষেত্রে শস্তও হইতেছে না,কাটাগাছও জন্মিতেছে । এমন অবস্থায় কুৎসিত আমোদের
উপলক্ষ্য এই মেলাগুলিকে যদি আমরা উদ্ধার না করি, তবে স্বদেশের কাছে ধর্মের কাছে
অপরাধী হইব । এ-কথা শুনিবামাত্র যেন আমাদের মধ্যে হঠাৎ একদল লোক অত্যন্ত
উত্তেজিত হইয়া না ওঠেন— এ-কথা
না বলিয়া বসেন যে, এই
মেলাগুলির প্রতি গবর্মেন্টের অত্যন্ত ঔদাসীন্ত দেখা যাইতেছে— অতএব আমরা সভা করিয়া কাগজে লিখিয়া
প্রবলবেগে গবর্মেন্টের সাকো নাড়াইতে শুরু করিয়া দিই— মেলাগুলির মাথার উপরে
দলবল-আইনকামুন-সমেত পুলিস কমিশনার ভাঙিয়া পৰ্ভুক— সমস্ত একদমে পরিষ্কার হইয়া যাক । ধৈর্য ধরিতে হইবে,— বিলম্ব হয়, বাধা পাই, সেও স্বীকার, কিন্তু এ সমস্ত আমাদের নিজের কাজ । চিরকাল ঘরের লক্ষ্মী আমাদের ঘর
নিকাইয়া আসিয়াছেন,— মুনিসিপালিটির
মজুর নয় । মুনিসিপালিটির সরকারি বঁাটায় পরিষ্কার করিয়া দিতে পারে বটে, কিন্তু লক্ষ্মীর সম্মার্জনীতে
পবিত্র করিয়া তোলে, এ-কথা
যেন আমরা না ভুলি । আমাদের দিশি লোকের সঙ্গে দিশি ধারায় মিলিবার যে কী উপলক্ষ্য হইতে
পারে, আমি তাহারই একটি দৃষ্টান্ত দিলাম
মাত্র, এবং এই উপলক্ষ্যটিকে নিয়মে বাধিয়া আত্মশক্তি ('ඵG আয়ত্তে আনিয়া কী করিয়া যে একট। দেশব্যাপী মঙ্গলব্যাপারে পরিণত করা
যাইতে পারে,
তাহারই আভাস দেওয়া গেল । র্যাহার রাজদ্বারে ভিক্ষাবৃত্তিকে
দেশের মঙ্গল-ব্যাপার বলিয়া গণ্যই করেন না তাহাদিগকে অন্য পক্ষে “পেসিমিস্ট, অর্থাং আশাহীনের দল নাম দিয়াছেন ৷
. অর্থাৎ রাজার কাছে কোনো আশা নাই বলিয়া আমরা যতটা হতাশ্বাস হুইয়া পড়িয়াছি, ততটা নৈরাগুকে তাহারা অমূলক বলিয়া
জ্ঞান করেন । আমি স্পষ্ট করিয়া বলিতেছি, রাজা আমাদিগকে মাঝে মাঝে লগুড়াঘাতে র্তাহার সিংহদ্বার
হইতে খেদাইতেছেন বলিয়াই যে অগত্য আত্মনির্ভরকে শ্রেয়োজ্ঞান করিতেছি, কোনোদিনই আমি এরূপ
দুর্লভদ্রাক্ষাগুচ্ছলুব্ধ হতভাগ্য শৃগালের সাত্বনাকে আশ্রয় করি নাই । আমি এইকথাই বলি, পরের প্রসাদভিক্ষাই যথার্থ “পেসিমিস্টআশাহীন দীনের লক্ষণ। গলায় কাছা না লইলে আমাদের গতি নাই, এ-কথা আমি কোনোমতেই বলিব না— আমি স্বদেশকে বিশ্বাস করি, আমি আত্মশক্তিকে সম্মান করি। আমি নিশ্চয় জানি যে, যে উপায়েই হউক, আমরা নিজের মধ্যে একটা স্বদেশীয়
স্বজাতীয় ঐক্য উপলব্ধি করিয়া আজ যে সার্থকতালাভের জন্য উৎসুক হইয়াছি, তাহার ভিত্তি যদি পরের পরিবর্তনশীল
প্রসন্নতার উপরেই প্রতিষ্ঠিত হয়, যদি তাহ বিশেষভাবে ভারতবর্ষের স্বকীয় না হয়, তবে তাহা পুনঃপুনই ব্যর্থ হইতে
থাকিবে । অতএব ভারতবর্ষের যথার্থ পথটি যে কী, আমাদিগকে চারিদিক হইতেই তাহার সন্ধান করিতে হইবে । মানুষের সঙ্গে মানুষের
আত্মীয়সম্বন্ধস্থাপনই চিরকাল ভারতবর্ষের সর্বপ্রধান চেষ্টা ছিল। দূর আত্মীয়ের সঙ্গে ও সম্বন্ধ
রাখিতে হুইবে, সস্তানেরা
বয়স্ক হইলেও সম্বন্ধ শিথিল হইবে না, গ্রামস্থ ব্যক্তিদের সঙ্গেও বর্ণ ও অবস্থা নিবিচারে
যথাযোগ্য আত্মীয়সম্বন্ধ রক্ষা করিতে হইবে ; গুরু-পুরোহিত, অতিথি-ভিক্ষুক, ভূস্বামী-প্রজাতৃত্য সকলের সঙ্গেই
যথোচিত সম্বন্ধ বাধা রহিয়াছে। এগুলি কেবলমাত্র শাস্ত্রবিহিত নৈতিক সম্বন্ধ নহে— এগুলি হৃদয়ের সম্বন্ধ । ইহারা কেহ বা পিতৃস্থানীয়, কেহ বা পুত্রস্থানীয়, কেহ বা ভাই, কেহ বা বয়স্ত । আমরা যে-কোনো মানুষের যথার্থ সময়ে
আসি, তাহার সঙ্গে একটা সম্বন্ধ নির্ণয়
করিয়া বসি । এইজন্য কোনো অবস্থায় মানুষকে আমরা আমাদের কার্ষসাধনের কল বা কলের
অঙ্গ বলিয়া মনে করিতে পারি না । ইহার ভালোমন দুই দিকই থাকিতে পারে, কিন্তু ইহা আমাদের দেশীয়, এমন কি তদপেক্ষাও বড়ো, ইহা প্রাচ্য । জাপান-যুদ্ধব্যাপার হইতে আমার এই
কথার দৃষ্টান্ত উজ্জল হইবে । যুদ্ধব্যাপারটি ब्रबौछ-ब्रध्नावलौ مهٔ একটা কলের জিনিস সন্দেহ নাই— সৈন্যদিগকে কলের মতো হইয়া উঠিতে হয় এবং কলের মতোই চলিতে
হয় । কিন্তু তৎসত্ত্বেও জাপানের প্রত্যেক
সৈন্ত সেই কলকে ছাড়াইয়া উঠিয়াছে, তাহারা অন্ধ জড়বৎ নহে, রক্তোম্মাদগ্ৰস্ত পশুবৎও নহে ; তাহারা প্রত্যেকে মিকাডোর সহিত এবং
সেই সূত্রে স্বদেশের সহিত সম্বন্ধবিশিষ্ট—সেই সম্বন্ধের নিকট তাহারা প্রত্যেকে আপনাকে উৎসর্গ করিতেছে । এইরূপে আমাদের পুরাকালে প্রত্যেক
ক্ষত্রসৈন্য আপন রাজাকে বা প্রভুকে অবলম্বন করিয়া ক্ষাত্রধর্মের কাছে আপনাকে
নিবেদন করিত—
রণক্ষেত্রে তাহারা
শতরঞ্জখেলার দাবাৰোড়ের মতো মরিত না— মানুষের মতো হৃদয়ের সম্বন্ধ লইয়া ধর্মের গৌরব লইয়া মরিত
। ইহাতে যুদ্ধব্যাপার অনেক সময়েই
বিরাট আত্মহত্যার মতো হইয়া দাড়াইত— এবং এইরূপ কাগুকে পাশ্চাত্ত্য সমালোচকেরা বলিয়া থাকেন, “ইহা চমৎকার— কিন্তু ইহা যুদ্ধ নহে।” জাপান এই চমৎকারিত্বের সঙ্গে
যুদ্ধকে মিশাইয়া প্রাচ্য-প্রতীচ্য উভয়েরই কাছে ধন্য হইয়াছেন । যাহা হউক, এইরূপই আমাদের প্রকৃতি । প্রয়োজনের সম্বন্ধকে আমরা হৃদয়ের
সম্বন্ধ দ্বারা শোধন করিয়া লইয়া তবেই ব্যবহার করিতে পারি। স্থতরাং অনাবশুক দায়িত্বও আমাদিগকে
গ্রহণ করিতে হয় । প্রয়োজনের সম্বন্ধ সংকীর্ণ —আপিসের মধ্যেই তাহার শেষ। প্রভূভূত্যের মধ্যে যদি কেবল
প্রভূভূত্যের সম্বন্ধটুকুই থাকে, তবে কাজ আদায় এবং বেতনদানের মধ্যেই সমস্ত চুকিয়া যায়, কিন্তু তাহার মধ্যে কোনোপ্রকার
আত্মীয়সম্বন্ধ স্বীকার করিলেই দায়িত্বকে পুত্রকন্যার বিবাহ এবং শ্রাদ্ধশান্তি
পর্যস্ত টানিয়া লইয়া যাইতে হয় ।
অনুচ্ছেদ:- সপ্তম
আমার কথার আর-একটা আধুনিক দৃষ্টান্ত
দেখুন। আমি রাজসাহি ও ঢাকার প্রোভিনশু্যাল কনফারেন্সে উপস্থিত ছিলাম । এই কনফারেন্স-ব্যাপারকে আমরা একটা
গুরুতর কাজের জিনিস বলিয়া মনে করি, সন্দেহ নাই— কিন্তু আশ্চর্য এই দেখিলাম, ইহার মধ্যে কাজের গরজের চেয়ে
অতিথিসৎকারের ভাবটাই স্বপরিস্ফুট । যেন বরষাত্রিদল গিয়াছি— আহার-বিহার আরাম-আমোদের জন্ত দাবি ও
উপদ্রব এতই অতিরিক্ত যে, তাহা
আহবানকর্তাদের পক্ষে প্রায় প্রাণান্তকর । যদি প্তাহার। বলিতেন, তোমরা নিজের দেশের কাজ করিতে
আসিয়াছ,
আমাদের মাথা কিনিতে আস নাই— এত চর্বাচুস্তলেঙ্কপেয়, এত শয়নাসন, এত লেমনেডসোডাওয়াটার-গাড়িঘোড়া, এত রসদের দায় আমাদের পরে কেন— তবে কথাট অন্যায় হইত না । কিন্তু কাজের দোহাই দিয়া ফাকায়
থাকাটা আমাদের জাতের লোকের কর্ম নয়। আমরা শিক্ষার চোটে যত ভয়ংকর কেজো হইয়া উঠি না কেন, তবু আহুৱানকারীকে কাজের উপরে উঠতে হইবে । কাজকেও আমরা হৃদয়ের সম্পর্ক হইতে
বঞ্চিত করিতে চাই না । বস্তুত কনফারেন্সে কেজো অংশ আমাদের চিত্তকে তেমন করিয়া আকর্ষণ করে
নাই, আতিথ্য যেমন করিয়াছিল । কনফারেন্স তাহার বিলাতি অঙ্গ হইতে
এই দেশী হৃদয়টুকুকে একেবারে বাদ দিতে পারে নাই । আহবানকারিগণ আহুতবর্গকে অতিথিভাবে
আত্মীয়ভাবে সংবর্ধনা করাকে আপনাদের দায় বলিয়া গ্রহণ করিয়াছিলেন । র্তাহাদের পরিশ্রম, কষ্ট, অর্থব্যয় যে কী পরিমাণে বাড়িয়া
উঠিয়াছিল,
তাহা যাহারা দেখিয়াছেন, তাহারাই বুঝিবেন । কনগ্রেসের মধ্যেও যে অংশ আতিথ্য, সেই অংশই ভারতবর্ষীয় এবং সেই অংশই
দেশের মধ্যে পুরা কাজ করে— যে
অংশ কেজো,
তিন দিন মাত্র তাহার কাজ, বাকি বৎসরটা তাহার সাড়াই পাওয়া
যায় না। অতিথির প্রতি যে সেবার সম্বন্ধ বিশেষরূপে ভারতবর্ষের প্রকৃতিগত, তাহাকে বৃহৎভাবে অনুশীলনের উপলক্ষ্য
ঘটিলে ভারতবর্ষের একটা বৃহৎ আনন্দের কারণ হয় । যে আতিথ্য গৃহে গৃহে আচরিত হয়, তাহাকে বৃহৎ পরিতৃপ্তি দিবার জন্য
পুরাকালে বড়ো বড়ো যজ্ঞানুষ্ঠান হইত— এখন বহুদিন হইতে সে-সমস্ত লুপ্ত হইয়াছে। কিন্তু ভারতবর্ষ তাহা ভোলে নাই
বলিয়া ষেই দেশের কাজের একটা উপলক্ষ্য অবলম্বন করিয়া জনসমাগম হইল, অমনি ভারতলক্ষ্মী তাহার বহুদিনের
অব্যবহৃত পুরাতন সাধারণ-অতিথিশালার দ্বার উদঘাটন করিয়া দিলেন, র্তাহার যজ্ঞভাণ্ডারের মাঝখানে
তাহার চিরদিনের আসনটি গ্রহণ করিলেন । এমনি করিয়া কনগ্রেস-কনফারেন্সের মাঝখানে খুব যখন বিলাতি
বক্তৃতার ধুম ও চটপটা করতালি— সেখানেও, সেই
ঘোরতর সভাস্থলেও, আমাদের
যিনি মাতা,
তিনি স্মিতমুখে তাহার
একটুখানি ঘরের সামগ্রী, তাহার
স্বহস্তরচিত একটুখানি মিষ্টান্ন, সকলকে ভাঙিয়া বাটিয়া খাওয়াইয়া চলিয়া যান, আর যে কী করা হইতেছে তাহা তিনি ভালো
বুঝিতেই পারেন না। মার মুখের হাসি আরো একটুখানি ফুটিত, যদি তিনি দেখিতেন, পুরাতন ধজ্ঞের ন্যায় এই সকল আধুনিক
যজ্ঞে কেবল বইপড়া লোক নয়, কেবল
ঘড়িচেনধারী লোক নয়— আহত-অনাহূত
আপামর সাধারণ সকলেই অবাধে এক হইয়াছে। সে-অবস্থায় সংখ্যায় ভোজ্য কম হইত, আড়ম্বরেও কম পড়িত— কিন্তু আনন্দে মঙ্গলে ও মাতার
আশীর্বাদে সমস্ত পরিপূর্ণ হইয়া উঠিত । যাহা হউক, ইহা স্পষ্ট দেখা যাইতেছে, ভারতবর্ষ কাজ করিতে বসিয়াও মানবসম্বন্ধের মাধুর্যটুকু
ভুলিতে পারে না । সেই সম্বন্ধের সমস্ত দায় সে স্বীকার করিয়া বসে । (FSkr রবীন্দ্র-রচনাবলী আমরা এই-সমস্ত
বহুতর অনাবশ্যক দায় সহজে স্বীকার করাতেই ভারতব অন্ধ-খঞ্জ-জাতুরদের প্রতিপালন
প্রভৃতি সম্বন্ধে কোনোদিন কাহাকেও ভাবিতে বিস্তাদান প্রভৃতি সামাজিক কর্তব্য সমাজ
হইতে স্খলিত হইয়া বাহিরে পড়িয়া থাকে, তবে আমরা একেবারেই অন্ধকার দেখিব না । গৃহের এবং পল্লীর ক্ষুদ্র সম্বন্ধ
অতিক্রম করিয়া প্রত্যেককে বিশ্বের সহিত যোগযুক্ত করিয়া অনুভব করিবার জন্য
হিন্দুধৰ্ম পন্থা নির্দেশ করিয়াছে । হিন্দুধর্ম সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তিকে প্রতিদিন পঞ্চযজ্ঞের
দ্বারা দেবতা, ঋষি, পিতৃপুরুষ, সমস্ত মনুষ্য ও পশুপক্ষীর সহিত
আপনার মঙ্গলসম্বন্ধ স্মরণ করিতে প্রবৃত্ত করিয়াছে । ইহা যথার্থরূপে পালিত হইলে
ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকের পক্ষে ও সাধারণভাবে বিশ্বের পক্ষে । এই উচ্চভাব হইতেই আমাদের সমাজে
প্রত্যেকের সহিত সমস্ত দেশের একটা প্রাত্যহিক সম্বন্ধ কি বাধিয়া দেওয়া অসম্ভব। প্রতিদিন প্রত্যেকে স্বদেশকে স্মরণ
করিয়৷ এক পয়সা বা তদপেক্ষা অল্প— একমুষ্টি বা অধমুষ্টি তণ্ডুলও স্বদেশবলিস্বরূপে উৎসর্গ
করিতে পারিবেন না ? হিন্দুধর্ম
কি আমাদের প্রত্যেককে প্রতিদিনই, এই আমাদের দেবতার বিহারস্থল, প্রাচীন ঋষিদিগের তপস্তার আশ্রম, পিতৃপিতামহদের মাতৃভূমি ভারতবর্ষের
সহিত প্রত্যক্ষসম্বন্ধে ভক্তির বন্ধনে বাধিয়া দিতে পারিবে না । স্বদেশের সহিত আমাদের মঙ্গলসম্বন্ধ— সে কি আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত
হইবে না। আমরা কি স্বদেশকে জলদান বিদ্যাদান প্রভৃতি মঙ্গলকর্মগুলিকে পরের
হাতে বিদায় দান করিয়া দেশ হইতে আমাদের চেষ্টা, চিস্তা ও হৃদয়কে একেবারে বিচ্ছিন্ন
করিয়া ফেলিব। গবর্মেন্ট আজ বাংলাদেশের জলকষ্ট নিবারণের জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা
দিতেছেন–
মনে করুন, অামাদের আন্দোলনের প্রচণ্ড তাগিদে
পঞ্চাশ লক্ষ টাকা দিলেন এবং দেশে জলের কষ্ট একেবারেই রহিল না— তাহার ফল কী হইল । তাহার ফল এই হইল যে, সহায়তালাভ-কল্যাণলাভের সূত্রে
দেশের যে-হৃদয় এতদিন সমাজের মধ্যেই কাজ করিয়াছে ও তৃপ্তি পাইয়াছে তাহাকে
বিদেশীর হাতে সমর্পণ করা হইল। যেখান হইতে দেশ সমস্ত উপকারই পাইবে সেইখানেই সে তাহার
সমস্ত হৃদয় স্বভাবতই দিবে। দেশের টাকা নানা পথ দিয়া নানা আকারে বিদেশের আত্মশক্তি দিকে ছুটিয়া চলিয়াছে
বলিয়। আমরা আক্ষেপ করি— কিন্তু দেশের হৃদয় যদি যায়, দেশের সহিত যতকিছু কল্যাণসম্বন্ধ একে একে সমস্তই যদি
বিদেশী গবর্ষেন্টরই করায়ত্ত হয়, আমাদের আর কিছুই অবশিষ্ট না থাকে, তবে সেটা কি বিদেশগামী টাকার
স্রোতের চেয়ে অল্প আক্ষেপের বিষয় হইবে । এইজন্তই কি আমরা সভা করি, দরখাস্ত করি, ও এইরূপে দেশকে অস্তরে বাহিরে
সম্পূর্ণভাবে পরের হাতে তুলিয়া দিবার চেষ্টাকেই বলে দেশহিতৈষিতা ? ইহা কদাচই হইতে পারে না । ইহা কখনোই চিরদিন এ-দেশে প্রশ্রয়
পাইবে না—
কারণ, ইহা ভারতবর্ষের ধর্ম নহে । আমরা আমাদের অতিদূর সম্পৰ্কীয়
নিঃস্ব আত্মীয়দিগকেও পরের ভিক্ষার প্রত্যাশী করিয়া দুরে রাখি নাই— তাহাদিগকেও নিজের সন্তানদের সহিত
সমান স্থান দিয়াছি ; আমাদের
বহুকষ্ট-অজিত অল্পও বহুদূর-কুটুম্বদের সহিত ভাগ করিয়া খাওয়াকে আমরা এক দিনের
জন্যও অসামান্য ব্যাপার বলিয়া কল্পনা করি নাই— আর আমরা বলিব, আমাদের জননী জন্মভূমির ভার আমরা বহন করিতে পারিব না ? বিদেশী চিরদিন আমাদের স্বদেশকে
অন্নজল ও বিদ্যা ভিক্ষা দিবে, আমাদের কর্তব্য কেবল এই যে, ভিক্ষার অংশ মনের মতো না হইলেই আমরা চীৎকার করিতে থাকিব ? কদাচ নহে, কদাচ নহে ! স্বদেশের ভার আমরা প্রত্যেকেই এবং
প্রতিদিনই গ্রহণ করিব— তাহাতে
আমাদের গৌরব,
আমাদের ধর্ম। এইবার সময় আসিয়াছে যখন আমাদের
সমাজ একটি স্ববৃহৎ স্বদেশী সমাজ হইয়া উঠিবে । সময় আসিয়াছে যখন প্রত্যেকে জানিবে
আমি একক নহি—
আমি ক্ষুদ্র হইলেও আমাকে
কেহ ত্যাগ করিতে পারিবে না এবং ক্ষুদ্রতমকেও আমি ত্যাগ করিতে পারিব না । তর্ক এই উঠিতে পারে যে, ব্যক্তিগত হৃদয়ের সম্বন্ধ দ্বারা
খুব বড়ো জায়গা ব্যাপ্ত করা সম্ভবপর হইতে পারে না ।
অনুচ্ছেদ:- অষ্টম
একটা ছোটো পল্লীকেই আমরা
প্রত্যক্ষভাবে আপনার করিয়া লইয়া তাহার সমস্ত দায়িত্ব স্বীকার করিতে পারি— কিন্তু পরিধি বিস্তীর্ণ করিলেই কলের
দরকার হয়—
দেশকে আমরা কখনোই পল্লীর
মতো করিয়া দেখিতে পারি না—এইজন্য
অব্যবহিত ভাবে দেশের কাজ করা যায় না, কলের সাহায্যে করিতে হয় । এই কল-জিনিসটা আমাদের ছিল না, স্বতরাং ইহা বিদেশ হইতে আনাইতে
হুইবে এবং কারখানা-ঘরের সমস্ত সাজসরঞ্জাম-আইনকামুন গ্রহণ ন করিলে কল চলিবে না । কথাটা অসংগত নহে । কল পাতিতেই হইবে । এবং কলের নিয়ম যে-দেশী হউক না কেন, তাহ মানিয়া না লইলে সমস্তই ব্যর্থ
হইবে। এ-কথা সম্পূর্ণ স্বীকার করিয়াও
বলিতে হইবে,
শুধু কলে ভারতবর্ষ চলিবে না— যেখানে আমাদের ব্যক্তিগত হৃদয়ের সম্বন্ধ আমরা প্রত্যক্ষভাবে অনুভব না করিব, সেখানে আমাদের সমস্ত প্রকৃতিকে
আকর্ষণ করিতে পারিবে না। ইহাকে ভালোই বল আর মন্দই বল, গালিই দাও অার প্রশংসাই কর, ইহা সত্য । অতএব আমরা যে-কোনো কাজে সফলতা লাভ
করিতে চাই,
এই কথাটি আমাদিগকে স্মরণ
করিতে হইবে । স্বদেশকে একটি বিশেষ ব্যক্তির মধ্যে আমরা উপলব্ধি করিতে চাই। এমন একটি লোক চাই, যিনি আমাদের সমস্ত সমাজের
প্রতিমাস্বরূপ হইবেন । র্তাহাকে অবলম্বন করিয়াই আমরা আমাদের বৃহৎ স্বদেশীয় সমাজকে ভক্তি
করিব, সেবা করিব । তাহার সঙ্গে যোগ রাখিলেই সমাজের প্রত্যেক
ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের যোগ রক্ষিত হইবে । পূর্বে যখন রাষ্ট্র সমাজের সহিত
অবিচ্ছিন্ন ছিল, তখন
রাজারই এই পদ ছিল । এখন রাজা সমাজের বাহিরে যাওয়াতে সমাজ শীর্ষহীন হুইয়াছে । সুতরাং দীর্ঘকাল হইতে বাধ্য হইয়া
পল্লীসমাজই খণ্ড খণ্ড ভাবে আপনার কাজ আপনি সম্পন্ন করিয়াছে—স্বদেশী সমাজ তেমন ঘনিষ্ঠভাবে
গড়িয়া বাড়িয়া উঠিতে পারে নাই। আমাদের কর্তব্য পালিত হইয়াছে বটে এবং হইয়াছে বলিয়াই আজও
আমাদের মকুন্যত্ব আছে— কিন্তু
আমাদের কর্তব্য ক্ষুদ্র হইয়াছে এবং ক্ষুদ্র হওয়াতে আমাদের চরিত্রে সংকীর্ণতা
প্রবেশ করিয়াছে। সংকীর্ণ সম্পূর্ণতার মধ্যে চিরদিন বন্ধ হইয়া থাকা স্বাস্থ্যকর নহে, এইজন্য যাহা ভাঙিয়াছে তাহার জন্য
আমরা শোক করিব না— যাহা
গড়িতে হইবে তাহার প্রতি আমাদের সমস্ত চিত্তকে প্রয়োগ করিব । আজকাল জড়ভাবে, যথেচ্ছাক্রমে, দায়ে পড়িয়া, যাহা ঘটিয়া উঠিতেছে তাহাই ঘটিতে দেওয়া
কখনোই আমাদের শ্রেয়স্কর হইতে পারে না । এক্ষণে আমাদের সমাজপতি চাই । তাহার সঙ্গে তাহার পার্ষদসভা থাকিবে, কিন্তু তিনি প্রত্যক্ষভাবে আমাদের
সমাজের অধিপতি হইবেন । আমাদের প্রত্যেকের নিকটে তাহারই মধ্যে সমাজের একতা সপ্রমাণ হইবে । আজ যদি কাহাকেও বলি সমাজের কাজ করে, তবে কেমন করিয়া করিব, কোথায় করিব, কাহার কাছে কী করিতে হইবে, তাহ ভাবিয়া তাহার মাথা ঘুরিয়া
যাইবে । অধিকাংশ লোকই আপনার কর্তব্য উদ্ভাবন করিয়া চলে না বলিয়াই রক্ষা । এমন স্থলে ব্যক্তিগত চেষ্টাগুলিকে
নিদিষ্ট পথে আকর্ষণ করিয়া লইবার জন্ত একটি কেন্দ্র থাকা চাই। আমাদের সমাজের কোনো জল সেই কেজের
স্থল অধিকার করিতে পারিবে না। আমাদের দেশে অনেক দলকেই দেখি, প্রথম উৎসাহের ধাক্কায় তাহারা যদি
বা অনেকগুলি ফুল ফুটাইয়া তোলে, কিন্তু শেষকালে ফল ধরাইতে পারে না । অত্মিশক্তি 岔鹃》 তাহার
বিবিধ কারণ থাকিতে পারে, কিন্তু
একটা প্রধান কারণ— আমাদের
দলের প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের মধ্যে দলের ঐক্যটিকে দৃঢ়ভাবে অনুভব ও রক্ষা করিতে
পারে না—শিথিল দায়িত্ব প্রত্যেকের স্কন্ধ
হইতে স্খলিত হইয়া শেষকালে কোথায় যে আশ্রয় লইবে, তাহার স্থান পায় না । আমাদের সমাজ এখন আর এরূপ ভাবে চলিবে
না । কারণ, বাহির হইতে যে উষ্ঠত শক্তি প্রত্যহ
সমাজকে আত্মসাৎ করিতেছে, তাহা
ঐক্যবদ্ধ,
তাহা দৃঢ়– তাহ আমাদের বিদ্যালয় হইতে আরম্ভ
করিয়া প্রতিদিনের দোকানবাজার পর্যন্ত অধিকার করিয়া সর্বত্রই নিজের একাধিপত্য
স্কুলসূক্ষ্ম সর্ব আকারেই প্রত্যক্ষগম্য করিয়াছে । এখন সমাজকে ইহার বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা
করিতে হইলে অত্যন্ত নিশ্চিতরূপে তাহার আপনাকে দাড় করাইতে হইবে । তাহণ করাইবার একমাত্র উপায়— এক জন ব্যক্তিকে অধিপতিত্বে বরণ করা, সমাজের প্রত্যেককে সেই একের মধ্যেই
প্রত্যক্ষ করা, তাহার
সম্পূর্ণ শাসন বহন করাকে অপমান জ্ঞান না করিয়া আমাদের স্বাধীনতারই অঙ্গ বলিয়া
অনুভব করা । এই সমাজপতি কখনো ভালো, কখনো মন্দ হইতে পারেন, কিন্তু সমাজ যদি জাগ্রত থাকে, তবে মোটের উপরে কোনো ব্যক্তি সমাজের
স্থায়ী অনিষ্ট করিতে পারে না। আবার, এইরূপ অধিপতির অভিষেকই সমাজকে জাগ্রত রাখিবার একটি প্রকৃষ্ট উপায় । সমাজ একটি বিশেষ স্থলে আপনার ঐক্যটি
প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করিলে তাঙ্গর শক্তি অজেয় হইয়া উঠিবে। ইহার অধীনে দেশের ভিন্ন ভিন্ন
নির্দিষ্ট অংশে ভিন্ন ভিন্ন নায়ক নিযুক্ত হইবেন । সমাজের সমস্ত অভাবমোচন, মঙ্গলকর্মচালনা ও ব্যবস্থারক্ষা
ইহারা করিবেন এবং সমাজপতির নিকট দায়ী থাকিবেন । পূর্বেষ্ট বলিয়াছি সমাজের প্রত্যেক
ব্যক্তি প্রত্যহ অতি অল্পপরিমাণেও কিছু স্বদেশের জন্য উৎসর্গ করিবে । তা ছাড়া, প্রত্যেক গুহে বিবাহদি শুভকর্ষে
গ্রামভাটি প্রভৃতির ন্যায় এই স্বদেশী সমাজের একটি প্রাপ্য আদায় তুরূহ বলিয়া মনে
করি না । ইহা যথাস্থানে সংগৃহীত হইলে অর্থাভাব ঘটিবে না । আমাদের দেশে স্বেচ্ছাদত্ত দানে বড়ো
বড়ো মঠমন্দির চলিতেছে, এ-দেশে
কি সমাজ ইচ্ছাপূর্বক আপনার আশ্রয়স্থান আপনি রচনা করিবে না ? বিশেষত যখন অল্পে জলে স্বাস্থ্যে
বিষ্ঠায় দেশ সৌভাগ্যলাভ করিবে, তখন কৃতজ্ঞতা কখনোই নিশ্চেষ্ট থাকিবে না । অবশু, এখন আমি কেবল বাংলাদেশকেই আমার
চোখের সামনে রাখিয়াছি । এখানে সমাজের অধিনায়ক স্থির করিয়া আমাদের সামাজিক স্বাধীনতাকে
যদি আমরা 《: 3 o রবীন্দ্র-রচনাবলী উজ্জল ও স্থায়ী
করিয়া তুলিতে পারি, তবে
ভারতবর্ষের অন্যান্য বিভাগও আমাদের অনুবর্তী হুইবে । এবং এইরূপে ভারতবর্ষের প্রত্যেক
প্রদেশ যদি নিজের মধ্যে একটি স্বনির্দিষ্ট ঐক্য লাভ করিতে পারে, তবে পরস্পরের সহযোগিতা করা
প্রত্যেকের পক্ষে অত্যন্ত সহজ হয়। একবার ঐক্যের নিয়ম এক স্থানে প্রবেশ করিয়া প্রতিষ্ঠিত
হইলে তাহা ব্যাপ্ত হইতে থাকে— কিন্তু রাশীরুত বিচ্ছিন্নতাকে কেবলমাত্র স্ত,পাকার করিতে থাকিলেই তাহা এক হয় না
। কী করিয়া কালের সহিত হৃদয়ের
সামঞ্জস্যবিধান করিতে হয়, কী
করিয়া রাজার সহিত স্বদেশের সংযোগসাধন করিতে হয়, জাপান তাহার नूछेखि দেখাইতেছে । সেই দৃষ্টান্ত মনে রাখিলে আমাদের
স্বদেশী সমাজের গঠন ও চালনের জন্য একই কালে আমরা সমাজপতি ও সমাজতন্ত্রের
কতৃত্বসমন্বয় করিতে পারিব— আমরা
স্বদেশকে একটি মানুষের মধ্যে প্রত্যক্ষ করিতে পারিব এবং তাহার শাসন স্বীকার করিয়া
স্বদেশী সমাজের যথার্থ সেবা করিতে পারিব । আত্মশক্তি একটি বিশেষ স্থানে সঞ্চয়
করা, সেই বিশেষ স্থানে উপলব্ধি করা, সেই বিশেষ স্থান হইতে সর্বত্র
প্রয়োগ করিবার একটি ব্যবস্থা থাকা, আমাদের পক্ষে কিরূপ প্রয়োজনীয় হইয়াছে একটু আলোচনা
করিলেই তাহা স্পষ্ট বুঝা যাইবে । গবর্মেন্ট নিজের কাজের সুবিধা অথবা যে কারণেই হোক, বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করিতে ইচ্ছা
করিয়াছেন—
আমরা ভয় করিতেছি, ইহাতে বাংলাদেশ দুর্বল হইয়া পড়িবে। সেই ভয় প্রকাশ করিয়া আমরা
কান্নাকাটি যথেষ্ট করিয়াছি । কিন্তু যদি এই কান্নাকাটি বৃথা হয়, তবে কি সমস্ত চুকিয়া গেল । দেশকে খণ্ডিত করিলে যে-সমস্ত অমঙ্গল
ঘটিবার সম্ভাবনা, তাহার
প্রতিকার করিবার জন্য দেশের মধ্যে কোথাও কোনো ব্যবস্থা থাকিবে না ? ব্যাধির বীজ বাহির হইতে শরীরের
মধ্যে না প্রবেশ করিলেই ভালো— কিন্তু তবু যদি প্রবেশ করিয়া বসে, তবে শরীরের অভ্যস্তরে রোগকে
ঠেকাইবার স্বাস্থ্যকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করিবার কোনো কতৃৰ্শক্তি কি থাকিবে না । সেই কতৃ শক্তি যদি আমরা সমাজের
মধ্যে স্থদূঢ় মুস্পষ্ট করিয়া রাখি, তবে বাহির হইতে বাংলাকে নির্জীব করিতে পারিবে না । সমস্ত ক্ষতকে আরোগ্য করা, ঐক্যকে আকর্ষণ করিয়া রাখা, মূৰ্ছিতকে সচেতন করিয়া তোলা ইহারই
কর্ম হইবে । আজকাল বিদেশী রাজপুরুষ সংকর্মের পুরস্কারস্বরূপ আমাদিগকে উপাধি
বিতরণ করিয়া থাকেন— কিন্তু
সংকর্মের সাধুবাদ ও আশীৰ্বাদ আমরা স্বদেশের কাছ হইতে পাইলেই যথার্থভাবে ধন্ত হইতে
পারি। স্বদেশের হইয়া পুরস্কৃত করিবার
শক্তি আমরা নিজের সমাজের মধ্যে যদি বিশেষভাবে স্থাপিত না করি, তবে চিরদিনের আত্মশক্তি අ8ළු মতো আপনাদিগকে এই একটি বিশেষ সার্থকতাদান হইতে বঞ্চিত করিব
। আমাদের দেশে মধ্যে মধ্যে সামান্ত
উপলক্ষ্যে হিন্দু-মুসলমানে বিরোধ বাধিয়া উঠে, সেই বিরোধ মিটাইয়া দিয়া উভয় পক্ষের মধ্যে
প্রীতিশাস্তিস্থাপন, উভয়
পক্ষের স্ব স্ব অধিকার নিয়মিত করিয়া দিবার বিশেষ কতৃত্ব সমাজের কোনো স্থানে যদি
না থাকে,
তবে সমাজকে বারে বারে
ক্ষতবিক্ষত হইয়া উত্তরোত্তর দুর্বল। অতএব একটি লোককে আশ্রয় করিয়া আমাদের সমাজকে এক জায়গায়
আপন হৃদয়স্থাপন, আপন
ঐক্য প্রতিষ্ঠা করিতেই হইবে, নহিলে শৈথিল্য ও বিনাশের হাত হইতে আত্মরক্ষার কোনো উপায় দেখি না । অনেকে হয়তো সাধারণভাবে আমার এ-কথা
স্বীকার করিবেন, কিন্তু
ব্যাপারখানা ঘটাইয়া তোলা র্তাহারা অসাধ্য বলিয়া মনে করিতে পারেন । র্তাহারা বলিবেন,— নির্বাচন করিব কী করিয়া, সবাই নির্বাচিতকে মানিবে কেন, আগে সমস্ত ব্যবস্থাতন্ত্র স্থাপন
করিয়া তবে তো সমাজপতির প্রতিষ্ঠা সম্ভবপর হইবে, ইত্যাদি । আমার বক্তব্য এই যে, এই সমস্ত তর্ক লইয়া আমরা যদি
একেবারে নিঃশেষপূর্বক বিচার বিবেচনা করিয়া লইতে বসি, তবে কোনো কালে কাজে নাম সম্ভব হইবে
না। এমন লোকের নাম করাই শক্ত, দেশের কোনো লোক বা কোনো দল র্যাহার
সম্বন্ধে কোনো আপত্তি না করিবেন । দেশের সমস্ত লোকের সঙ্গে পরামর্শ মিটাইয়া লইয়া লোককে
নির্বাচন করা সাধ্য হইবে না । আমাদের প্রথম কাজ হইবে— যেমন করিয়া হউক, একটি লোক স্থির করা এবং র্তাহার নিকটে বাধ্যতা স্বীকার
করিয়া ধীরে ধীরে ক্রমে ক্রমে তাহার চারিদিকে একটি ব্যবস্থাতন্ত্র গড়িয়া তোলা । যদি সমাজপতি-নিয়োগের প্রস্তাব
সময়োচিত হয়, যদি
রাজা সমাজের অন্তর্গত না হওয়াতে সমাজে অধিনায়কের যথার্থ অভাব ঘটিয়া থাকে, যদি পরজাতির সংঘর্ষে আমরা প্রত্যহ
অধিকারচু্যত হইতেছি বলিয়া সমাজ নিজেকে বাধিয়া তুলিয়া উঠিয়া দাড়াইবার জন্য
ইচ্ছুক হয়,
তবে কোনো একটি যোগ্য লোককে
দাড় করাইয়া তাহার অধীনে এক দল লোক যথার্থভাবে কাজে প্রবৃত্ত হইলে এই
সমাজ-রাজতন্ত্র দেখিতে দেখিতে প্রস্তুত হইয়া উঠিবে— পূর্ব হইতে হিসাব করিয়া কল্পনা
করিয়া আমরা যাহা আশা করিতে না পারিব, তাহাও লাভ করিব— সমাজের অন্তর্নিহিত বুদ্ধি এই ব্যাপারের চালনাভার আপনিই
গ্রহণ করিবে । 蟒 সমাজে
অবিচ্ছিন্নভাবে সকল সময়েই শক্তিমান ব্যক্তি থাকেন না, কিন্তু দেশের যে শক্তি আপাতত ৰোগ্য লোকের অভাবে কাজে লাগিল না, সে-শক্তি যদি সমাজে কোথাও রক্ষিত
হইবার স্থানও না পায়, তবে
সে সমাজ ফুট। কলসের মতো শূন্ত হইয়া যায় । আমি যে সমাজপতির কথা বলিতেছি, তিনি সকল সময়ে যোগ্য লোক না
হক্টলেও সমাজের শক্তি সমাজের আত্মচেতনা তাহাকে অবলম্বন করিয়া ৰিপ্লুত হষ্টয়া
থাকিবে । অবশেষে বিধাতার আশীর্বাদে এই শক্তিসঞ্চয়ের সহিত যখন যোগ্যতার যোগ
হইবে, তখন দেশের মঙ্গল দেখিতে দেখিতে
আশ্চর্ধবলে আপনাকে সর্বত্র বিস্তীর্ণ করিবে । আমরা ক্ষুদ্র দোকানির মতো সমস্ত
লাভলোকসানের হিসাব হাতে হাতে দেখিতে চাই– কিন্তু বড়ো ব্যাপারের হিসাব তেমন করিয়া মেলে না । দেশে এক-একটা বড়ো দিন আসে, সেই দিন বড়ো লোকের তলবে দেশের
সমস্ত সালতামামি নিকাশ বড়ো খাতায় প্রস্তুত হইয়া দেখা দেয়। রাজচক্রবর্তী অশোকের সময়ে একবার
বৌদ্ধসমাজের হিসাব তৈরি হইয়াছিল । আপাতত আমাদের কাজ-দপ্তর তৈরি রাখা, কাজ চালাইতে থাকা ; যেদিন মহাপুরুষ হিসাব তলব করিবেন, সেদিন অপ্রস্তুত হইয়া শির নত করিব
না— দেখাইতে পারিব, জমার ঘরে একেবারে শূন্ত নাই । সমাজের সকলের চেয়ে যাহাকে বড়ো
করিব, এতবড়ো লোক চাহিলেই পাওয়৷ যায় না।
অনুচ্ছেদ:- দশম
বস্তুত রাজা তাহার সকল প্রজারই
চেয়ে যে স্বভাবত বড়ো, তাহা
নহে । কিন্তু রাজ্যই রাজাকে বড়ো করে । জাপানের মিকাডো জাপানের সমস্ত স্বধী, সমস্ত সাধক, সমস্ত শূরবীরদের দ্বারাই বড়ো। আমাদের সমাজপতিও সমাজের মহবেষ্ট মহৎ
হইতে থাকিবেন । সমাজের সমস্ত বড়ো লোকই তাহাকে বড়ো করিয়া তুলিবে । মন্দিরের মাথায় যে স্বর্ণকলস থাকে, তাহা নিজে উচ্চ নহে— মন্দিরের উচ্চতাই তাহাকে উচ্চ করে । আমি ইহা বেশ বুঝিতেছি, আমার এই প্রস্তাব যদি বা অনেকে
অনুকূলভাবেও গ্রহণ করেন, তথাপি
ইহা অবাধে কার্যে পরিণত হইতে পারিবে না। এমন কি, প্রস্তাবকারীর অযোগ্যতা ও অন্যান্য
বহুবিধ প্রাসঙ্গিক ও অপ্রাসঙ্গিক দোষত্রুটি ও স্বলন সম্বন্ধে অনেক স্পষ্ট স্পষ্ট
কথা এবং অনেক অস্পষ্ট আভাস আজ হইতে প্রচার হইতে থাকা আশ্চর্য নহে । আমার বিনীত নিবেদন এই যে, আমাকে আপনার ক্ষমা করিবেন । আদ্যকার সভামধ্যে আমি আত্মপ্রচার
করিতে আসি নাই, এ-কথা
বলিলেও পাছে অহংকার প্রকাশ করা হয়, এ-জন্ত আমি কুষ্ঠিত আছি । আমি অদ্য যাহা বলিতেছি, আমার সমস্ত দেশ আমাকে তাহা বলাইতে
উদ্যত আত্মশক্তি করিয়াছে। তাহা আমার কথা নহে, তাহ আমার স্বষ্টি নহে ; তাহা আমাৰুত্বক উচ্চারিত মাত্র । আপনারা এ শঙ্কামাত্র করিবেন না, আমি আমার অধিকার ও ৰোগ্যতার সীমা
বিস্তৃত হইয়া স্বদেশী সমাজ গঠনকার্ষে নিজেকে অতু্যগ্রভাবে খাড়া করিয়া তুলিব । আমি কেবল এইটুকুমাত্র বলিব, আন্থন, আমরা মনকে প্রস্তুত করি— ক্ষুদ্র দলাদলি, কুতর্ক, পরনিন্দ, সংশয় ও অতিবুদ্ধি হইতে হৃদয়কে
সম্পূর্ণভাবে ক্ষালন করিয়া অদ্য মাতৃভূমির বিশেষ প্রয়োজনের দিনে, জননীর বিশেষ আহবানের দিনে চিত্তকে
উদার করিয়া কর্মের প্রতি অনুকুল করিয়া, সর্বপ্রকার লক্ষ্যবিহীন অতি স্বল্প যুক্তিবাদের ভঙুলতাকে
সবেগে আবর্জনাস্তুপের মধ্যে নিক্ষেপ করিয়া, এবং নিগৃঢ় আত্মাভিমানকে তাহার শতসহস্র রক্ত তুষার্ত শিকড়
সমেত হৃদয়ের অন্ধকার গুহাতল হইতে সবলে উৎপাটিত করিয়া সমাজের শূন্য আসনে
বিনম্র-বিনীতভাবে আমাদের সমাজপতির অভিষেক করি, আশ্রয়চু্যত সমাজকে সনাথ করি— শুভক্ষণে আমাদের দেশের মাতৃগৃহকক্ষে
মঙ্গলপ্রদীপটিকে উজ্জল করিয়া তুলি— শখ বাজিয়া উঠুক, ধূপের পবিত্র গন্ধ উদগত হইতে থাকৃ— দেবতার অনিমেষ কল্যাণদৃষ্টির দ্বারা
সমস্ত দেশ আপনাকে সর্বতোভাবে সার্থক বলিয়া একবার অনুভব করুক । এই অভিষেকের পরে সমাজপতি কাহাকে
তাহার চারিদিকে আকর্ষণ করিয়া লইবেন, কী ভাবে সমাজের কার্যে সমাজকে প্রবৃত্ত করিবেন, তাহা আমার বলিবার বিষয় নহে। নিঃসন্দেহ, যেরূপ ব্যবস্থা আমাদের চিরন্তন
সমাজপ্রকৃতির অনুগত, তাহাই
উহাকে অবলম্বন করিতে হইবে— স্বদেশের
পুরাতন প্রকৃতিকেই আশ্রয় করিয়া তিনি নূতনকে যথাস্থানে যথাযোগ্য আসনদান করিবেন। আমাদের দেশে তিনি লোকবিশেষ ও দলবিশেষের
হাত হইতে সর্বদাই বিরুদ্ধবাদ ও অপবাদ সহ করিবেন, ইহাতে সন্দেহমাত্র নাই । কিন্তু মহৎ পদ আরামের স্থান নহে— সমস্ত কলরব-কোলাহলের মধ্যে আপনার
গৌরবে তাহাকে দৃঢ়গম্ভীরভাবে অবিচলিত থাকিতে হইবে ।অতএব র্যাহাকে আমরা সমাজের সর্বোচ্চ
সম্মানের দ্বারা বরণ করিব, র্তাহাকে
এক দিনের জন্যও আমরা মুখস্বচ্ছন্দতার আশা দিতে পারিব না । আমাদের যে উদ্ধত নব্যসমাজ কাহাকেও
হৃদয়ের সহিত শ্রদ্ধা করিতে সন্মত না হইয়া নিজেকে প্রতিদিন আশ্রদ্ধেয় করিয়া
তুলিতেছে,
সেই সমাজের
স্থচিমুখ-কন্টকখচিত ঈর্ষাসম্ভপ্ত আসনে ধাহাকে আসীন হইতে হইবে, বিধাতা যেন তাহাকে প্রচুর পরিমাণে
বল ও সহিষ্ণুতা প্রদান করেন— তিনি যেন নিজের অস্তঃকরণের মধ্যেই শাস্তি ও কর্নের মধ্যেই পুরস্কার
লাভ করিতে পারেন। নিজের শক্তিকে আপনারা অবিশ্বাস
করিবেন না,
আপনারা নিশ্চয় জানিবেন--
সময় উপস্থিত হইয়াছে। নিশ্চয় জানিবেন, ভারতবর্ষের মধ্যে একটি বধিয়া তুলিবার ধর্ম চিরদিন বিরাজ করিয়াছে। নানা প্রতিকুল ব্যাপারের মধ্যে
পড়িয়াও ভারতবর্ষ বরাবর একটা ব্যবস্থা করিয়া তুলিয়াছে, তাই আজও রক্ষা পাইয়াছে । এই ভারতবর্ষের উপরে আমি
বিশ্বাসস্থাপন করি । এই ভারতবর্ষ এখনই এই মুহুর্তেই ধীরে ধীরে নূতন কালের সহিত আপনার
পুরাতনের আশ্চর্য একটি সামঞ্জস্য গড়িয়া তুলিতেছে । আমরা প্রত্যেকে যেন সজ্ঞানভাবে
ইহাতে যোগ দিতে পারি,— জড়ত্বের
বশে বা বিদ্রোহের তাড়নায় প্রতিক্ষণে ইহার প্রতিকুলত না করি । বাহিরের সহিত হিন্দুসমাজের সংঘাত এই
নূতন নহে। ভারতবর্ষে প্রবেশ করিয়াই আর্যগণের সহিত এখানকার আদিম অধিবাসীদের
তুমুল বিরোধ বাধিয়াছিল । এই বিরোধে আর্যগণ জয়ী হইলেন, কিন্তু অনার্যেরা আদিম অস্টে লিয়ান বা আমেরিকগণের মতো
উৎসাদিত হইল না ; তাহারা
আর্ষ উপনিবেশ হইতে বহিষ্কৃত হইল না ; তাহারা আপনাদের আচারবিচারের সমস্ত
পার্থক্যসত্ত্বেও একটি সমাজতন্ত্রের মধ্যে স্থান পাইল । তাহাদিগকে লইয়া আর্যসমাজ বিচিত্র ! এই সমাজ আর-একবার সুদীর্ঘকাল
বিশ্লিষ্ট হইয়া গিয়াছিল । বৌদ্ধপ্রভাবের সময় বৌদ্ধধর্মের আকর্ষণে ভারতবর্ষীয়ের
সহিত বহুতর পরদেশীয়ের ঘনিষ্ঠ সংস্রব ঘটিয়াছিল । বিরোধের সংস্রবের চেয়ে এই মিলনের
সংস্রব আরো গুরুতর । বিরোধে আত্মরক্ষার চেষ্টা বরাবর জাগ্রত থাকে— মিলনের অসতর্ক অবস্থায় অতি সহজেই
সমস্ত একাকার হইয়া যায়। বৌদ্ধ-ভারতবর্ষে তাহাই ঘটিয়াছিল । সেই এশিয়াব্যাপী ধর্মপ্লাবনের সময়
নানা জাতির আচারব্যবহার ক্রিয়াকম ভাসিয়া আসিয়াছিল, কেহ ঠেকায় নাই । কিন্তু এই অতিবৃহৎ উচ্ছ স্বলতার
মধ্যেও ব্যবস্থাস্থাপনের প্রতিভা ভারতবর্ষকে ত্যাগ করিল না । যাহা-কিছু ঘরের এবং যাহা-কিছু
অভ্যাগত,
সমস্তকে একত্র করিয়া লইয়া
পুনর্বার ভারতবর্ষ আপনার সমাজ স্থবিহিত করিয়া গড়িয়া তুলিল ; পূর্বাপেক্ষ আরো বিচিত্র হইয়া উঠিল
। কিন্তু এই বিপুল বৈচিত্র্যের মধ্যে
আপনার একটি ঐক্য সর্বত্রই সে গ্রথিত করিয়া দিয়াছে । আজ অনেকেই জিজ্ঞাসা করেন, নানা স্বতোবিরোধ আত্মখণ্ডন-সংকুল এই
হিন্দুধর্মের এই হিন্দুসমাজের ঐক্যট। কোনখানে । স্বম্পষ্ট উত্তর দেওয়া কঠিন। স্ববৃহৎ পরিধির কেন্দ্র খুজিয়া
পাওয়াও তেমনি কঠিন,— কিন্তু
কেন্দ্র তাহার আছেই। ছোটাে গোলকের গোলত্ব বুঝিতে আত্মশক্তি কষ্ট হয় না, কিন্তু গোল পৃথিবীকে যাহারা খণ্ড খণ্ড করিয়া দেখে, তাহারা ইহাকে চ্যাপটা বলিয়াই অনুভব
করে। তেমনি হিন্দুসমাজ নানা পরস্পর-অসংগত
বৈচিত্রাকে এক করিয়া লওয়াতে তাহার ঐক্যস্বত্র নিগৃঢ় হইয়া পড়িয়াছে। এই ঐক্য অঙ্গুলির দ্বারা নির্দেশ
করিয়া দেওয়া কঠিন, কিন্তু
ইহা সমস্ত আপাত-প্রতীয়মান বিরোধের মধ্যেও দৃঢ়ভাবে যে আছে, তাহা আমরা স্পষ্টই উপলব্ধি করিতে
পারি। ইহার পরে এই ভারতবর্ষেই মুসলমানের
সংঘাত আসিয়া উপস্থিত হইল। এই সংঘাত সমাজকে যে কিছুমাত্র আক্রমণ করে নাই, তাহা বলিতে পারি না । তখন হিন্দুসমাজে এই পরসংঘাতের সহিত
সামঞ্জস্তসাধনের প্রক্রিয়া সর্বত্রই আরম্ভ হইয়াছিল। হিন্দু ও মুসলমান সমাজের মাঝখানে
এমন একটি সংযোগস্থল স্বষ্ট হইতেছিল, যেখানে উভয় সমাজের সীমারেখা মিলিয়া আসিতেছিল ; নানকপন্থী কবীরপন্থী ও নিম্নশ্রেণীর
বৈষ্ণবসমাজ ইহার দৃষ্টান্তস্থল । আমাদের দেশে সাধারণের মধ্যে নানা স্থানে ধর্ম ও আচার লইয়া
যে-সকল ভাঙাগড়া চলিতেছে, শিক্ষিত-সম্প্রদায়
তাহার কোনো খবর রাখেন না । যদি রাখিতেন তো দেখিতেন, এখনো ভিতরে ভিতরে এই সামঞ্জস্তসাধনের
সজীব প্রক্রিয়া বন্ধ নাই । সম্প্রতি আর-এক প্রবল বিদেশী আর-এক ধর্ম, আচারব্যবহার ও শিক্ষাদীক্ষা লইয়া
আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে । এইরূপে পৃথিবীতে যে চারি প্রধান ধর্মকে আশ্রয় করিয়া চার বৃহৎ
সমাজ আছে–
হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান, খ্রীস্টান— তাহারা সকলেই ভারতবর্ষে আসিয়া
মিলিয়াছে। বিধাতা যেন একটা বৃহৎ সামাজিক সম্মিলনের জন্য ভারতবর্ষেই একটা বড়ো
রাসায়নিক কারখানাঘর খুলিয়াছেন ।
অনুচ্ছেদ:- একাদশ
এখানে একটা কথা আমাকে স্বীকার করিতে
হইবে যে,
বৌদ্ধ-প্রাচুর্ভাবের সময়
সমাজে যে একটা মিশ্রণ ও বিপর্যস্ততা ঘটিয়াছিল, তাহাতে পরবর্তী হিন্দুসমাজের মধ্যে একটা ভয়ের লক্ষণ
রহিয়া গেছে । নূতনত্ব ও পরিবর্তন মাত্রেরই প্রতি সমাজের একটা নিরতিশয় সন্দেহ
একেবারে মজ্জার মধ্যে নিহিত হইয়া রহিয়াছে ! এরূপ চিরস্থায়ী আতঙ্কের অবস্থায়
সমাজ অগ্রসর হইতে পারে না । বাহিরের সহিত প্রতিযোগিতায় জয়ী হওয়া তাহার পক্ষে অসাধ্য
হইয়া পড়ে। যে-সমাজ কেবলমাত্র আত্মরক্ষার দিকেই তাহার সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে, সহজে চলাফেরার ব্যবস্থা সে আর করিতে
পারে না । মাঝে মাঝে বিপদের আশঙ্কা, আঘাতের আশঙ্কা স্বীকার করিয়াও প্রত্যেক সমাজকে স্থিতির
সঙ্গে সঙ্গে গতির বন্দোবস্তও রাখিতে হয় । নহিলে তাহাকে পঙ্গু হইয়া বাচিয়া
থাকিতে হয়,
সংকীর্ণতার মধ্যে আবদ্ধ
হইতে হয়—
তাহা একপ্রকার জীবন্ম ত্যু। ক্ষা করিবার জন্ত, পরসংস্রব হইতে নিজেকে সর্বতোভাবে
অবরুদ্ধ রাখিবার জন্য নিজেকে জাল দিয়া বেড়িয়াছে । ইহাতে ভারতবর্ষকে আপনার একটি মহৎ পদ
হারাইতে হইয়াছে। এক সময়ে ভারতবর্ষ পৃথিবীতে গুরুর আসন লাভ করিয়াছিল ; ধর্মে, বিজ্ঞানে, দর্শনে ভারতবর্ষীয় চিত্তের সাহসের
সীমা ছিল না ;
সেই চিত্ত সকল দিকে
স্বত্বৰ্গম সুদূর প্রদেশসকল অধিকার করিবার জন্য আপনার শক্তি অবাধে প্রেরণ করিত । এইরূপে ভারতবর্ষ যে গুরুর সিংহাসন
জয় করিয়াছিল, তাহা
হষ্টতে আজ সে ভ্রষ্ট হইয়াছে— আজ তাহাকে ছাত্ৰত স্বীকার করিতে হইতেছে । ইহার কারণ, আমাদের মনের মধ্যে ভয় ঢুকিয়াছে। সমুদ্রষাত্রা আমরা সকল দিক দিয়াই
ভয়ে ভয়ে বন্ধ করিয়া দিয়াছি— কি জলময় সমুদ্র, কি জ্ঞানময় সমুদ্র । আমরা ছিলাম বিশ্বের, দাড়াইলাম পল্লীতে । সঞ্চয় ও রক্ষা করিবার জন্য সমাজে
যে ভীরু স্ত্রীশক্তি আছে, সেই
শক্তিই কৌতুহলপর পরীক্ষাপ্রিয় সাধনশীল পুরুষশক্তিকে পরাভূত করিয়া একাধিপত্য লাভ
করিল। তাই আমরা জ্ঞানরাজ্যেও
দৃঢ়সংস্কারবদ্ধ স্ত্রৈণপ্রকৃতিসম্পন্ন হইয়া পড়িয়াছি। জ্ঞানের বাণিজ্য ভারতবর্ষ যাহা-কিছু
আরম্ভ করিয়ছিল, যাহা
প্রত্যহ বাড়িয়া উঠিয়া জগতের ঐশ্বর্যবিস্তার করিতেছিল, তাহ আজ অন্তঃপুরের অলংকারের বাক্সে
প্রবেশ করিয়া আপনাকে অত্যন্ত নিরাপদ জ্ঞান করিতেছে ; তাহা আর বাড়িতেছে না, যাহা খোওয়া যাইতেছে তাহা খোওয়াই
যাইতেছে । বস্তুত, এই
গুরুর পদই আমরা হারাইয়াছি । রাজ্যেশ্বরত্ব কোনোকালে আমাদের দেশে চরমসম্পদ রূপে ছিল না— তাহা কোনোদিন আমাদের দেশের সমস্ত
লোকের হৃদয় অধিকার করিতে পারে নাই— তাহার অভাব আমাদের দেশের প্রাণান্তকর অভাব নহে। ব্রাহ্মণত্বেৰ অধিকার, অর্থাৎ জ্ঞানের অধিকার, ধর্মের অধিকার, তপস্তার অধিকার আমাদের সমাজের
যথার্থ প্রাণের আধার ছিল । যখন হইতে আচারপালনমাত্রই তপস্যার স্থান গ্রহণ করিল, যখন হইতে আপন ঐতিহাসিক মর্যাদা
বিস্তৃত হইয়া আমাদের দেশে ব্রাহ্মণ ব্যতীত অার-সকলেই আপনাদিগকে শূদ্র অর্থাৎ
অনার্ধ বলিয়া স্বীকার করিতে কুষ্ঠিত হইল না— সমাজকে নব নব তপস্যার ফল, নব নব ঐশ্বর্য বিতরণের ভার
যে-ব্রাহ্মণের ছিল সেই ব্রাহ্মণ যখন আপন যথার্থ মাহাত্মা বিসর্জন দিয়া সমাজের
স্বারদেশে নামিয়া আসিয়া কেবলমাত্র পাহার দিবার ভার গ্রহণ করিল,— তখন হইতে আমরা অন্যকেও কিছু দিতেছি
না, আপনার যাহা ছিল তাহাকেও অকৰ্মণ্য ও
বিকৃত করিতেছি সহায়তা করিবার সামগ্ৰী কী উদ্ভাবন করিতেছে, ইহারই সদুত্তর দিয়া প্রত্যেক জাতি
প্রতিষ্ঠালাভ করে । যখন হইতে সেই উদ্ভাবনের প্রাণশক্তি কোনো জাতি হারায়, তখন হইতেই সেই বিরাটুমানবের কলেবরে
পক্ষাঘাতগ্রস্ত অঙ্গের স্থায় সে কেবল ভারস্বরূপে বিরাজ করে । বস্তুত, কেবল টিকিয়া থাকাই । ভারতবর্ষ রাজ্য লইয়া মারামারি, বাণিজ্য লইয়া কাড়াকড়ি করে নাই । আজ যে তিব্বত-চীন-জাপান অভ্যাগত
যুরোপের ভয়ে সমস্ত দ্বার-বাতায়ন রুদ্ধ করিতে ইচ্ছুক, সেই তিব্বত-চীন-জাপান ভারতবর্ষকে
গুরু বলিয়া সমাদরে নিরুৎকণ্ঠিতচিত্তে গৃহের মধ্যে ডাকিয়া লইয়াছেন । ভারতবর্ষ সৈন্য এবং পণ্য লইয়া
সমস্ত পৃথিবীকে অস্থিমজ্জায় উদবেজিত করিয়া ফিরে নাই— সর্বত্র শাস্তি, সানা ও ধর্মব্যবস্থা স্থাপন করিয়া
মানবের ভক্তি অধিকার করিয়াছে। এইরূপে যে-গৌরব সে লাভ করিয়াছে তাহা তপস্তার দ্বারা
করিয়াছে এবং সে গৌরব রাজচক্রবর্তিত্বের চেয়ে বড়ো । সেই গৌরব হারাইয়া আমরা যখন আপনার
সমস্ত পুটলিপাটলা লইয়া ভীতচিত্তে কোণে বসিয়া আছি, এমন সময়েই ইংরেজ আসিবার প্রয়োজন
ছিল । ইংরেজের প্রবল আঘাতে এই ভীরু পলাতক
সমাজের ক্ষুদ্র বেড়া অনেক স্থানে ভাঙিয়াছে। বাহিরকে ভয় করিয়া যেমন দূরে ছিলাম, বাহির তেমনি হুড়মুড় করিয়া
একেবারে ঘাড়ের উপরে আসিয়া পড়িয়াছে— এখন ইহাকে ঠেকায় কাহার সাধ্য। এই উৎপাতে আমাদের ষে প্রাচীর
ভাঙিয়া গেল,
তাহাতে দুইটা জিনিস আমরা
আবিষ্কার করিলাম। আমাদের কী আশ্চর্ষ শক্তি ছিল, তাহা চোখে পড়িল এবং আমরা কী আশ্চর্য অশক্ত হইয়া
পড়িয়াছি,
তাহাও ধরা পড়িতে विलच रुहेल
नां । আজ
আমরা ইহা উত্তমরূপেই বুঝিয়াছি যে, তফাতে গা-ঢাকা দিয়া বসিয়া থাকাকেই আত্মরক্ষা বলে না। নিজের অস্তনিহিত শক্তিকে সর্বতোভাবে
জাগ্রত কয়৷ চালনা করাই আত্মরক্ষার প্রকৃত উপায় । ইহা বিধাতার নিয়ম । ইংরেজ তভক্ষণ পর্বত্ত আমাদের
চিত্তকে অভিভূত করিবেই, যতক্ষণ
আমাদের চিত্ত জড়ত্ব ত্যাগ করিয়া তাহার নিজের উদ্যমকে কাজে না লাগাইবে । কোণে বসিয়া কেবল “গেল গেল” বলিয়া হাহাকার করিয়া মরিলে কোনো
ফল নাই। সকল বিষয়ে ইংরেজের অনুকরণ করিয়া ছদ্মবেশ পরিয়া বাচিবার
যে-চেষ্টা তাহাও নিজেকে ভোলানো
মাত্র। আমরা প্রকৃত ইংরেজ হইতে পারিব না, নকল ইংরেজ হইয়াও আমরা ইংরেজকে
ঠেকাইতে পারিব না । আমাদের বুদ্ধি, আমাদের হৃদয়, আমাদের রুচি যে প্রতিদিন জলের দরে ৰিকাইয়া যাইতেছে, তাহ প্রতিরোধ করিবার একমাত্র উপায়— আমরা নিজে যাহা তাহাই সজ্ঞানভাবে, সবলভাবে, সচলভাবে সম্পূর্ণভাবে হইয়া উঠা ।আমাদের যে শক্তি আবদ্ধ আছে, তাহা বিদেশ হইতে বিরোধের আঘাত
পাইয়াই মুক্ত হইবে— কারণ, আজ পৃথিবীতে তাহার কাজ আসিয়াছে। আমাদের দেশের তাপসেরা তপস্যার
দ্বারা যে-শক্তি সঞ্চয় করিয়া গিয়াছেন তাহা মহামূল্য, বিধাতা তাহাকে নিষ্ফল করিবেন না। সেইজন্য উপযুক্ত সময়েই তিনি
নিশ্চেষ্ট ভারতকে সুকঠিন পীড়নের দ্বারা জাগ্রত করিয়াছেন । বছর মধ্যে ঐক্য-উপলব্ধি, বিচিত্রের মধ্যে ঐক্যস্থাপন— ইহাই ভারতবর্ষের অন্তর্নিহিত ধর্ম । ভারতবর্ষ পার্থক্যকে বিরোধ বলিয়া
জানে না—
সে পরকে শক্ৰ বলিয়া কল্পনা
করে না । এইজন্যই ত্যাগ না করিয়া, বিনাশ না করিয়া, একটি বৃহৎ ব্যবস্থার মধ্যে সকলকেই সে স্থান দিতে চায়। এই জন্য সকল পন্থাকেই সে স্বীকার
করে,— স্বস্থানে সকলেরই মাহাত্ম্য সে
দেখিতে পায় । ভারতবর্ষের এই গুণ থাকাতে, কোনো সমাজকে আমাদের বিরোধী কল্পনা করিয়া আমরা ভীত হইব না । প্রত্যেক নব নব সংঘাতে অবশেষে আমরা
আমাদের বিস্তারেরই প্রত্যাশা করিব। হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান, খ্রীস্টান ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে
পরস্পর লড়াই করিয়া মরিবে না— এইখানে তাহারা একটা সামঞ্জস্ত খুজিয়া পাইবে । সেই সামঞ্জস্য অহিন্দু হইবে না, তাহা বিশেষভাবে হিন্দু। তাহার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যতই দেশবিদেশের
হউক, তাহার প্রাণ, তাহার আত্মা ভারতবর্ষের । আমরা ভারতবর্ষের বিধাতুনির্দিষ্ট এই
নিয়োগটি যদি স্মরণ করি তবে আমাছের লক্ষ্য স্থির হইবে, লজ্জা দূর হইবে— ভারতবর্ষের মধ্যে যে একটি মৃত্যুহীন
শক্তি আছে তাহার সন্ধান পাইব । আমাদিগকে ইহা মনে রাখিতেই. হইবে ষে, যুরোপের জ্ঞানবিজ্ঞানকে যে চিরকালই
আমরা শুদ্ধমাত্র ছাত্রের মতো গ্রহণ করিব, তাহা নহুে— ভারতবর্ষের সরস্বতী জ্ঞানবিজ্ঞানের সমস্ত দল ও দলাদলিকে
একটি শতদল পদ্মের মধ্যে বিকশিত করিয়া তুলিবেন, তাহাদের খণ্ডতা দূর করিবেন । আমাদের ভারতের মনীষী ডাক্তার
শ্ৰীযুক্ত জগদীশচন্দ্র বস্তুতত্ত্ব, উদ্ভিদতত্ত্ব ও জভতত্বের ক্ষেত্রকে এক সীমানার মধ্যে
আনিবার পক্ষে সহায়তা করিয়াছেন— মনস্তত্ত্বকেও যে তিনি কোনো-একদিন ইহাঙ্গের এক কোঠায় আনিয়া দাড়
করাইবেন না,
তাহা বলিতে আত্মশক্তি © ©Ꮌ পারি না। এই ঐক্যসাধনই ভারতবর্ষীয় প্রতিভার
প্রধান কাজ । ভারতবর্ষ কাহাকেও ত্যাগ করিবার, কাহাকেও দূরে রাখিবার পক্ষে নহে– ভারতবর্ষ সকলকেই স্বীকার করিবার, গ্রহণ করিবার, বিরাট একের মধ্যে সকলকেই
স্বস্বপ্রধান প্রতিষ্ঠা উপলব্ধি করিবার পন্থা এই বিবাদনিরত ব্যবধানসংকুল পৃথিবীর
সম্মুখে একদিন নির্দেশ করিয়া দিবে । , সেই স্থমহং দিন আসিবার পূর্বে— “একবার তোরা মা বলিয়া ডাক!” ষে একমাত্র মা দেশের প্রত্যেককে
কাছে টানিবার, অনৈক্য
ঘুচাইবার,
রক্ষা করিবার জন্য নিয়ত
ব্যাপৃত রহিয়াছেন, যিনি
আপন ভাণ্ডারের চিরসঞ্চিত জ্ঞানধর্ম নানা আকারে নানা উপলক্ষ্যে আমাদের প্রত্যেকেরই
অন্তঃকরণের মধ্যে অশ্রাস্তভাবে সঞ্চার করিয়া আমাদের চিত্তকে সুদীর্ঘ পরাধীনতার
নিশীথরাত্রে বিনাশ হইতে রক্ষা করিয়া আসিয়াছেন, মদোন্ধত ধনীর ভিক্ষুশালার প্রান্তে
র্তাহার একটুখানি স্থান করিয়া দিবার জন্য প্রাণপণ চীৎকার না করিয়া দেশের
মধ্যস্থলে সস্তানপরিবৃত যজ্ঞশালায় তাহাকে প্রত্যক্ষ উপলব্ধি করে । আমরা কি এই জননীর জীর্ণ গৃহ সংস্কার
করিতে পারিব না। পাছে সাহেবের বাড়ির বিল চুকাইয়া উঠিতে না পারি, পাছে আমাদের সাজসজ্জা
আসবাব-আড়ম্বরে কমতি পড়ে, এইজন্যই, আমাদের যে-মাতা একদিন অন্নপূর্ণ
ছিলেন পরের পাকশালার স্বারে তাহারই অল্পের ব্যবস্থা করিতে হইবে ? আমাদের দেশ তো একদিন ধনকে তুচ্ছ
করিতে জনিত,
একদিন দারিদ্র্যকেও শোভন ও
মহিমান্বিত করিতে শিখিয়াছিল,— আজ আমরা কি টাকার কাছে সাষ্টাঙ্গে ধূল্যবলুষ্ঠিত হইয়া আমাদের
সনাতন স্বধৰ্মকে অপমানিত করিব । আজ আবার আমরা সেই শুচিশুদ্ধ, সেই মিতসংযত, সেই স্বল্লোপকরণ জীবনযাত্র গ্রহণ
করিয়া আমাদের তপস্বিনী জননীর সেবায় নিযুক্ত হইতে পারিব না ? আমাদের দেশে কলার পাতায় খাওয়া তো
কোনোদিন লজ্জাকর ছিল না, একলা
খাওয়াই লজ্জাকর ; সেই
লজ্জা কি আমরা আর ফিরিয়া পাইব না। আমরা কি আজ সমস্ত দেশকে পরিবেশন করিতে প্রস্তুত হইবার জন্য
নিজের কোনো আরাম কোনো আড়ম্বর পরিত্যাগ করিতে পারিব না । একদিন যাহা আমাদের পক্ষে নিতান্তই
সহজ ছিল তাহা কি আমাদের পক্ষে আজ একেবারেই অসাধ্য হইয়া উঠিয়াছে। কখনোই নহে। নিরতিশয় দুঃসময়েও ভারতবর্ষের
নিঃশব্দ প্রকাও প্রভাব ধীরভাবে নিগৃঢ়ভাবে আপনাকে জয়ী করিয়া তুলিয়াছে। আমি নিশ্চয় জানি, আমাদের দুই-চারি দিনের এই ইস্কুলের
মুখস্থ বিদ্যা সেই চিরন্তন প্রভাবকে লঙ্ঘন করিতে পারিবে না। আমি নিশ্চয় জানি, ভারতবর্ষের সুগম্ভীর আহবান প্ৰতি মুহুর্তে আমাদের বক্ষণকুহরে
ধ্বনিত হইয়া উঠিতেছে ; এবং
আমরা নিজের অলক্ষ্যে শনৈঃশনৈ সেই ভারতবর্ষের দিকেই চলিয়াছি । অাজ যেখানে পথটি আমাদের
মঙ্গলদীপোজ্জল গৃহের দিকে চলিয়া গেছে সেইখানে আমাদের গৃহ যাত্রারম্ভের অভিমুখে
দাড়াইয়া একবার তোরা মা বলিয়া ডাক্ !” একবার স্বীকার করো, মাতার সেবা স্বহস্তে করিবার জন্য
অন্য আমরা প্ৰস্তুত হইলাম ; একবার
স্বীকার করো যে, দেশের
উদ্দেশে প্ৰত্যহ আমরা পূজার নৈবেদ্য উৎসৰ্গ কবি ; একবার প্রতিজ্ঞা করো, জন্মভূমির সমস্ত মঙ্গল আমরা পরের
কাছে নিঃশেষে বিকাইয়া দিয়া নিজেরা অত্যন্ত নিশ্চিন্তচিত্তে পদাহত অকালকুষ্মাণ্ডের
ন্যায় অধঃপাতের সোপান হইতে সোপানান্তরে গড়াইতে গড়াইতে চরম লাঞ্ছনার তলদেশে
অাসিয়া উত্তীৰ্ণ হইব না ।
0 Comments