বীরাঙ্গনা কাব্য
কবিতা:-
দুস্মন্তের প্রতি শকুন্তলা
বন-নিবাসিনী দাসী নমে রাজপদে,
রাজেন্দ্র! যদিও তুমি ভুলিয়াছ তারে,
ভুলিতে তোমারে কভু পারে কি অভাগী?
হায়! আশামদে মত্ত আমি পাগলিনী!
হেরি যদি ধূলারাশি,
হে
নাথ আকাশে;
পবন-স্বনন যদি শুনি দূর বনে;
অমনি চমকি ভাবি,
- মদকল
করী,
বিবিধ রতন অঙ্গে,
পশিছে
আশ্রমে,
পদাতিক, বাজীরাজী,
সুরথ
সারথি,
কিঙ্কর, কিঙ্করী সহ!
আশার ছলনে,
প্রিয়ম্বদা,
অনসূয়া,
ডাকি
সখীদ্বয়ে,
কহি ‘হ্যাদে দেখ,
সই,
এতদিনে
আজি
স্মরিলা লো প্রাণেশ্বর এ তাঁর দাসীরে!
ওই দেখ, ধূলারাশি উঠিছে
গগনে!
ওই শোন কোলাহল! পুরবাসী যত
আসিছে লইতে মোরে নাথের আদেশে!’
নীরবে ধরিয়া গলা কাঁদে প্রিয়ম্বদা;
কাঁদে অনসূয়া সই বিলাপি বিষাদে!
দ্রুতগতি ধাই আমি সে নিকুঞ্জবনে,
যথায়, হে মহীনাথ,
পূজিনু
প্রথমে
পদযুগ; চারিদিকে চাহি
ব্যগ্রভাবে।
দেখি প্রফুল্লিত ফুল,
মুকুলিত
লতা;
শুনি কোকিলের গীত,
অলির
গুঞ্জর,
স্রোতোনাদ;
মরমরে
পাতাকুল নাচি;
কুহরে কপোত,
সুখে
বৃক্ষশাখে বসি,
প্রেমালাপে কপোতীর মুখে মুখ দিয়া।
সুধি গঞ্জি ফুলপুঞ্জে;
‘রে
নিকুঞ্জশোভা,
কি সাধে হাসিস তোরা?
কেন
সমীরণে
বিতরিস আজি হেথা পরিমল সুধা?’
কহি পিকে- ‘কেন তুমি,
পিককুল-পতি,
এ স্বরলহরী আজি বরিষ এ বনে?
কে করে আনন্দধ্বনি নিরানন্দকালে?
মদনের দাস মধু;
মধুর
অধীনে
তুমি; সে মদন মোহে
যার রূপ গুণে,
কি সুখে গাও হে তুমি তাঁহার বিরহে?’
অলির গুঞ্জর শুনি ভাবি মৃদুস্বরে
কাঁদিছেন বনদেবী দুঃখিনীর দুঃখে!
শুনি স্রোতোনাদ ভাবি- গম্ভীর নিনাদে
নিন্দিছেন বনদেব তোমায়,
নৃমণি,-
কাঁপি ভয়ে- পাছে তিনি শাপ দেন রোষে।
কহি পত্রে,-
‘শোন;
পত্র,-
সরস
দেখিলে
তোরে, সমীরণ আসি নাচে
তোরে লয়ে
প্রেমামোদে,
কিন্তু
যবে শুখাইস কালে
তুই, ঘৃণা করি তোরে
তাড়ায় সে দূরে;-
তেমনি দাসীরে কিরে ত্যজিলা নৃপতি?’
মুদি পোড়া আঁখি বসি রসালের তলে;
ভ্রান্তিমদে মাতি ভাবি পাইব সত্বরে
পাদপদ্ম! কাঁপে হিয়া দুরুদুরু করি
শুনি যদি পদশব্দ! উল্লাসে উন্মীলি
নয়ন, বিষাদে কাঁদি
হেরি কুরঙ্গীরে!
গালি দিয়া দূর তারে করি করাঘাতে!
ডাকি উচ্চে অলিরাজে,
কহি,-
‘ফুলসখে
শিলীমুখ,
আসি
তুমি আক্রম গুঞ্জরি
এ পোড়া অধর পুনঃ । রক্ষিতে দাসীরে
সহসা দিবেন দেখা পুরুকুলনিধি!’
কিন্তু বৃথা ডাকি,
কান্ত। কি লোভে ধাইবে
আর মধুলোভী অলি এ মুখ নিরখি,-
শুখাইলে ফুল,
কবে
কে আদরে তারে?
কাঁদিয়া প্রবেশি,
প্রভু,
সে
লতামণ্ডপে,
যথায় ভাবিয়া দেখ,
পড়ে
যদি মনে,
নরেন্দ্র;
যথায়
বসি, প্রেমকুতূহলে,
লিখিল কমলদলে গীতিকা অভাগী;-
যথায় সহসা তুমি প্রবেশি,
জুড়ালে
বিষম বিরহজ্বালা! পদ্মপর্ণ নিয়া
কত যে কি লিখি নিত্য কব তা কেমনে?
কভু প্রভঞ্জনে কহি কৃতাঞ্জলিপুটে;-
‘উড়ায়ে লেখন
মোর, বায়ুকুলরাজা,
ফেল রাজপদতলে যথা রাজালয়ে
বিরাজেন রাজাসনে রাজকুলমণি!’
সম্বোধি কুরঙ্গে কভু কহি শূন্যমনে;-
‘মনোরথ-গতি তোরে
দিয়াছেন বিধি,
কুরঙ্গ! লেখন লয়ে যা চলি সত্বরে
যথায় জীবিতনাথ! হায় মরি আমি
বিরহে। শৈশবে তোরে পালিনু যতনে;
বাঁচা রে এ পোড়া প্রাণ আজি কৃপা করি!’
আর যে কি কই কারে,
কি
কাজ কহিয়া,
নরেশ্বর?
ভাবি
দেখ পড়ে যদি মনে,
অনসূয়া প্রিয়ম্বদা সখীদ্বয় বিনা,
নাহি জন জানে,
হায়,
এ
বিজন বনে
অভাগীর দুঃখ-কথা। এ দুজন যদি
আসে কাছে মুছি আঁখি অমনি;
কেননা
বিবশা দেখিলে মোরে রোষে ঋষিবালা,
নিন্দে তোমা,
হে
নরেন্দ্র, মন্দ কথা কয়ে!-
বজ্রসম অপবাদ বাজে পোড়া বুকে।
ফাটি অন্তরিত রাগে- বাক্য নাহি ফোটে!
আর আর স্থল যত,-
কাঁদিয়া
কাঁদিয়া
ভ্রমি সে সকল স্থলে! যে তরুর মূলে
গান্ধর্ব্ববিবাহচ্ছলে ছলিলে দাসীরে,
যে নিকুঞ্জে ফুলশয্যা সাজাইয়া সাধে
সেবিল চরণ দাসী কানন-বাসরে,-
কি ভাব উদয়ে মনে,
দেখ
মনে ভাবি,
ধীমান, যখন পশি সে
নিকুঞ্জধামে!—
হে বিধাতঃ,
এই
কি রে ছিল তোর মনে?
এই কি রে ফলে ফল প্রেমতরু-শাখে?
এইরূপে ভ্রমি নিত্য আমি অনাথিনী,
প্রাণনাথ!ভাগ্যে বৃদ্ধা গৌতমী তাপসী
পিতৃস্বসা,--
মনঃ
তার রত তপজপে;
তা না হলে সর্বনাশ অবশ্য হইত
এত দিনে। নাহি সাধ বাঁধিতে কবরী
ফুলরত্নে আর,
দেব!
মলিন বাকলে
আবরি মলিন দেহ;
নাহি
অন্নে রুচি;
না জানি কি কহি কারে,
হায়,
শূন্যমনে!
বিষাদে নিঃশ্বাস ছাড়ি,
পড়ি
ভূমিতলে,
হারাই সতত জ্ঞান;
চেতন
পাইয়া
মেলি যবে আঁখি,
দেখি
তোমায় সম্মুখে!
অমনি পসারি বাহু ধাই ধরিবারে
পদযুগ, না পাইয়া
কাঁদি হাহারবে!
কে কবে, কি পাপে সহি
হেন বিড়ম্বনা!
কি পাপে পীড়েন বিধি,
শুধিব
তা কারে?
দয়া করি প্রভু যদি বিরামদায়িনী
নিদ্রা, সুকোমল কোলে,
দেন
স্থান মোরে,
কত যে স্বপনে দেখি,
কব
তা কেমনে?
স্বর্ণরত্ন-সংঘটিত দেখি অট্টালিকা;
দ্বিরদ-রদ-নির্ম্মিত দুয়ারে দুয়ারী
দ্বিরদ; সুবর্ণাসন দেখি
স্থানে স্থানে;
ফুলশয্যা;
বিদ্যাধরী-গঞ্জিনীকিঙ্করী;
কেহ গায়,
কেহ
নাচে; যোগায় আনিয়া
বিবিধ ভূষণ কেহ;
কেহ
উপাদেয়
রাজভোগ! দেখি মুক্তা মণি রাশি রাশি,
অলকা-সদনে যেন! শুনি বীণা-ধ্বনি;
গন্ধামোদে মাতে মনঃ,
নন্দন-কাননে-
(শুনেছি এ কথা,
নাথ,
তাত
কণ্বমুখে)
নন্দন-কাননান্তরে বসন্ত যেমনি!
তোমায়, নৃমণি,
দেখি
স্বর্ণসিংহাসনে!
শিরোপরি রাজছত্র;
রাজদণ্ড
হাতে,
মণ্ডিত অমূল-রত্নে;
সসাগরা
ধরা,
রাজকর করে,
নত
রাজীব-চরণে!
কত যে জাগিয়া কাঁদি কব তা কাহারে?
জানে দাসী,
হে
নরেন্দ্র, দেবেন্দ্র-সদৃশ
ঐশ্বর্য,
মহিমা
তব; অতুল জগতে
কুল, মান ধনে তুমি,
রাজকুল
পতি!
কিন্তু নাহি লোভে দাসী বিভব! সেবিবে
দাসীভাবে পা দুখানি- এই লোভ মনে,-
এ চির-আশা,
নাথ,
এ
পোড়া হৃদয়ে!
বন-নিবাসিনী আমি,
বাকল-বসনা,
ফলমূলাহারী নিত্য,
নিত্য
কুশাসনে
শয়ন; কি কাজ,
প্রভু,
রাজসুখ-ভোগে?
আকাশে করেন কেলি লয়ে কলাধরে
রোহিণী; কুমুদী তাঁরে
পূজে মর্ত্যতলে!
কিঙ্করী করিয়া মোরে রাখ রাজপদে।
চির অভাগিনী আমি! জনক জননী
ত্যজিলা শৈশবে মোরে,
না
জানি, কি পাপে?
পরান্নে বাঁচিল প্রাণ- পরের পালনে!
এ নব যৌবন এবে ত্যজিলা কি তুমি,
প্রাণপতি?
কোন
দোষে, কহ, কান্ত,
শুনি,
দাসী শকুন্তলা দোষী ও চরণ-যুগে?
এ মনে যে সুখ-পাখী ছিল বাসা বাঁধি,
কেন ব্যাধবেশে আসি বধিলে তাহারে,
নরাধিপ? শুনিয়াছি
রথীশ্রেষ্ঠ তুমি,
বিখ্যাত ভারতক্ষেত্রে ভীম বাহুবলে;
কি যশঃ লভিলা,
কহ,
যশস্বি,
বিনাশি-
অবলা কুলের বালা আমি- সুখ মম!
আসিবেন তাত কণ্ব ফিরি বনে বনে;
কি কব তাঁহারে,
নাথ,
কহ,
তা
দাসীরে?
নিন্দে অনসূয়া যবে মন্দ কথা কয়ে,
অপবাদে প্রিয়ম্বদা তোমায়,-
কি
বলে?
বুঝাবে এ দোঁহে দাসী,
কহ
তা দাসীরে?
কহ কি বলিয়া,
দেব,
হায়,
বুঝাইব
এ পোড়া পরাণ আমি- এ মিনতি পদে!
বনচর চর,
নাথ!
না জানি কিরূপে
প্রবেশিবে রাজপুরে রাজ-সভাতলে?
কিন্তু মজ্জমান জন,
শুনিয়াছি,
ধরে
তৃণে, আর কিছু যদি না
পায় সম্মুখে!
জীবনের আশা,
হায়,
কে
ত্যজে সহজে
For download click here 👇👇👇
0 Comments